দেশে নানাভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির দুরভিসন্ধি করছেন কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কাজে লাগিয়ে তাদের অনুসারীদের একযোগে মাঠে নামানোর প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে নাশকতার টার্গেট হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের পাঁচটি পয়েন্ট বেছে নেওয়া হয়েছে। ভয়ংকর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে গাজীপুরে। সেখানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে পুরো শিল্পাঞ্চল এলাকায় পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে গোপন তৎপরতা চলছে। আর ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখ নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া স্পর্শকাতর স্থান হিসাবে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড়, কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু সড়ক বেছে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে পুলিশ। এসব বিষয়ে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল থেকে যুগান্তরের ব্যুরোপ্রধান ও প্রতিনিধিরাও নানা তথ্য পাঠিয়েছেন।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশনস) রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী নানাভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে অপচেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা হতে দেওয়া হবে না। বিভিন্ন ফাঁকফোকরে, এমনকি রাতের অন্ধকারেও ঝটিকা মিছিল বের করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু পুলিশের তৎপরতার মুখে তারা দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও অনেককেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গাজীপুরে লক্ষাধিক লোক জড়ো করার পরিকল্পনার খবর আমরা পেয়েছি। কোনো অবস্থায়ই সেটা করতে দেওয়া হবে না। গাজীপুরের এসপি ও মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইলসহ যেসব পয়েন্টকে তারা টার্গেট করেছেন, সেসব এলাকায় পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। তারা কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করতে পারবে না।’
জানা যায়, পলাতক নেতাদের পরিকল্পনায় বেশ কিছু দিন ধরেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে ঝটিকা মিছিল বের করছেন। এটি মূলত করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোভাব বোঝার জন্য। ভেতরে ভেতরে তারা বড় ধরনের নাশকতার ছক নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ নাশকতার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে গাজীপুরে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন। ইতোমধ্যে তার একটি অডিও বার্তাও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে-শ্রমিক ছাঁটাই, গুজব, বকেয়া বেতন-বোনাসসহ নানা অজুহাতে মাঝেমধ্যেই গাজীপুর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নানা ইস্যুতে শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এসব ইস্যু কাজে লাগিয়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ‘উত্তপ্ত আগুনে ঘি’ ঢালতে পারেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা যে কোনো সময় ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনে তারা ইন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা বিক্ষোভ মিছিল, রেলসড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। ওইদিন তারা বেলা ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে মহাসড়কে চলাচলকারী সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জের যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এছাড়াও গাজীপুরের চৌরাস্তায় এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর চন্দ্রা এলাকায় অবরোধ হলে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার যাত্রীরা দুর্ভোগের শিকার হন। এই আন্দোলন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের। শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে নারায়ণগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসাবে বিবেচিত হয়। নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা দখলে নিতে পারলে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছিল নারায়ণগঞ্জ। ওই সময় পুরো নারায়ণগঞ্জ এলাকা দখলে নিয়ে ভয়ংকর নাশকতা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২৪শের জুলাই বিপ্লবেও মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার ওপর ভয়ংকর দমন-পীড়ন ও প্রকাশ্যে মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। এবারও নারায়ণগঞ্জ ঘিরে ভয়াবহ নৈরাজ্যের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর এ সংক্রান্ত হুমকির একটি অডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
গোয়েন্দাদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রবেশমুখ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর দিয়েই চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৫টি জেলার মানুষ ও পণ্য পরিবহণ হয়। নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে এই পয়েন্ট আটকে দিতে পারলেই বন্ধ হয়ে যায় দেশের অর্থনীতির বড় ‘লাইফ লাইন’। এখান দিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদিত গার্মেন্ট পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য চট্টগ্রাম পোর্টে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে আমদানিকৃত বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যসহ গার্মেন্ট এক্সেসরিজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আনা হয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিদিন ৪৪ হাজার পরিবহণ যাতায়াত করে। তবে ঈদে বা কোনো বিশেষ ছুটির সময়ে এই সংখ্যা বেড়ে ৬০ থেকে ৬২ হাজারে পৌঁছায়। পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটাতেই এই পয়েন্টকে টার্গেট করা হয়েছে।
বিপ্লবী সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান বলেন, ঢাকা চট্টগ্রাম ও ঢাকা সিলেট মহাসড়ক সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপর্ণ। এই সড়কের প্রতি সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত। যাতে কোনো অবস্থায়ই এই সড়কে পরিবহণ চলাচলে বাধাগ্রস্ত না হয়। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে এই সড়কে পরিবহণ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে।
আরও জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অচল করতে নারায়ণগঞ্জের পরই কুমিল্লাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আতঙ্ক ছড়াতে ইতোমধ্যে সেখানে কয়েকবার মহাসড়কে মিছিল ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। নাশকতার প্রস্তুতির সময় পুলিশ গত কয়েকদিনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। সম্প্রতি মহাসড়কের সদর দক্ষিণ এলাকায় ছাত্রলীগের মিছিল ও অপতৎপরতা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় সদর দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়।
সদর দক্ষিণ মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি নাশকতার পরিকল্পনা আমরা নস্যাৎ করেছি। তারা যেন মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে আমরা তৎপর আছি। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি জুনায়েদ চৌধুরী বলেন, দাউদকান্দি এলাকায় দুই দফা নাশকতার চেষ্টা করলে আমরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
নাশকতা পরিকল্পনার আরেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ঢাকা-ভাঙ্গা হাইওয়ে এক্সপ্রেসওয়ের ভাঙ্গা গোলচত্বর। এই চত্বর আটকে গেলে দুর্ভোগে পড়েন দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষ। সংসদীয় আসন থেকে ভাঙ্গা উপজেলার দুইটি ইউনিয়ন আলগী ও হামেরদী কেটে নেওয়ার প্রতিবাদে গত ৭ দিনে স্থানীয় মানুষের ব্যানারে ভাঙ্গা গোলচত্বর অবরোধ করা হয়। তবে নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে পতিত সরকারের অপশক্তি। এই চত্বর ঘিরে আওয়ামী লীগের নাশকতার পরিকল্পনার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক নাশকতা পরিকল্পনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। ঢাকার প্রবেশপথ টাঙ্গাইল বা গাজীপুরের মহাসড়ক অবরোধ করলে ১৯ জেলার পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে যে কোনো আন্দোলন জোরালো করতে ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে নাশকতা ঘটানোর টার্গেট থাকে। পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এ পয়েন্ট ঘিরে নাশকতার পরিকল্পনা করেছেন।
টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম লাবলু বলেন, গার্মেন্ট কর্মী, রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীরা যখনই আন্দোলন করেন, তখনই মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। এতে বিপাকে পড়েন চালক ও যাত্রীরা।