৪০০ বছর পুরোনো মুঘল স্থাপত্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’। এটি ইসলামি স্থাপত্য শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুঘল আমলের স্থাপনাগুলোর একটি এ মসজিদ।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের নতুন হাবলি (আখন্দ বাড়ি) গ্রামে ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে মসজিদটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ও নান্দনিক নির্মাণ শৈলীর কারণে এটি দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। অপরূপ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদটি দেখতে অনেকটা তাজমহলের মতো।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোড অংশের কাছে সরাইল উপজেলা চত্বর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে এই মসজিদটি ইসলামী স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। এর সুদৃশ্য গম্বুজ, সুসজ্জিত মিহরাব, সুশোভিত মিনার ও দেয়ালের খোদাই করা কারুকাজ মুগ্ধ করার মতো।
মসজিদের ভেতরের অংশে রয়েছে সুন্দর ক্যালিগ্রাফি, যাতে পবিত্র কুরআনের আয়াত অঙ্কিত রয়েছে। প্রাচীন বাংলার মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া স্পষ্টভাবে মসজিদটির গঠন শৈলীতে প্রতিফলিত হয়েছে।
জনশ্রুতি অনুসারে, ১৬৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আরিফাইল গ্রামে মসজিদটি নির্মিত হয়। দরবেশ শাহ আরিফ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তার নামানুসারেই এই মসজিদের নামকরণ করা হয়।
আরও বলা হয়ে থাকে, মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে এক বিশাল দীঘি। যা স্থানীয়দের কাছে ‘সাগরদীঘি’ নামে পরিচিত। এটি মসজিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই দীঘির পানি পান করলে রোগ মুক্তি লাভ করা যায়। এছাড়া মসজিদটির দক্ষিণে রয়েছে দুটি কবর। যা ‘জোড়া কবর’ বা ‘রহস্যময় কবর’ নামে পরিচিত। কবর দুটিতেও মুঘল স্থাপত্যকলা ও অপূর্ব নির্মাণ শৈলী বিদ্যমান। এগুলো ঘিরে নানা কল্প কথা প্রচলিত রয়েছে।
অনেকে বিশ্বাস করেন, মাজার হিসেবে পরিচিত এই কবরের সামনে মান্নত করলে তা পূর্ণ হয়। এ জন্য প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে আসেন।
৮০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের এই মসজিদের চার কোণে চারটি বুরুজ এবং তিনটি গম্বুজ রয়েছে। ভেতরে প্রতিটি গম্বুজের নিচের অংশ মসজিদটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছে। গম্বুজগুলোর গায়ে খোদাই করা পদ্মফুলের নকশা মুঘল স্থাপত্যের পরিচয় বহণ করে।
ঐতিহাসিক সূত্রমতে, এক সময় সরাইল ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী। এটি বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর শাসনাধীন ছিল। ধারণা করা হয়, ঈশা খাঁ এই মসজিদ ও এর পার্শ্ববর্তী ‘জোড়াকবর’ নির্মাণ করেন।
অনেকে মনে করেন, ঈশা খাঁর দুই স্ত্রীর কবর এখানে স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের স্মরণে এর সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। কবর দুটি পাশাপাশি থাকার কারণে এটি ‘জোড়াকবর’ নামে পরিচিতি পায়।
একটি রহস্যজনক তথ্য হলো, কবর দুটির নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে, যার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না।
জনশ্রুতি অনুসারে, ভীতি ও কুসংস্কারের কারণে কেউই এই সুড়ঙ্গের শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে সাহস করেনি, ফলে এটি আজও রহস্যাবৃত।
অন্যদিকে, মসজিদের দেয়াল অত্যন্ত পুরু হওয়ায় ভেতরে যে কোনো শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে এক ভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করে। অনেকের কাছে এটি রহস্যময় মনে হয়। কেউ কেউ একে অলৌকিক আলামত হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রতিদিন এখানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি অংশ নেন। বিশেষ করে জুমার দিনে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব, স্থাপত্যশৈলী এবং রহস্যময়তা মিলিয়ে ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও পর্যটকদের জন্য এক দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে।
স্থানীয়দের মতে, সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে মসজিদটি সংরক্ষণ করা হলে, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে। মসজিদটি সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান মসজিদের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্যে আধুনিকায়নের কাজ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আকিল খান বলেন, শত শত বছর ধরে আরিফাইল মসজিদ টিকে আছে ইতিহাসের নির্দশন হিসেবে। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি আশপাশে কোনো মসজিদ ছিল না। সে সময় এখানে এসে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন নামাজ আদায় করতেন।
তিনি বলেন, এই স্থাপনাটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসে। তবে এখানে আসার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সরু হওয়ায় দর্শনার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। সরকারের কাছে অনুরোধ রাস্তাটি প্রশস্ত করলে চলাচলের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা শিব্বির আহমেদ বলেন, ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে মসজিদটি এর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এটি ঈশা খাঁ আমলের নির্মিত হয়েছে বলে আমরা বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনেছি। অনেকেই আবার গায়েবি মসজিদ বলেও ডাকে একে। এর উত্তর পাশে একটি বড় দিঘী রয়েছে। এটি সাগর দিঘী পরিচিত। এর পানি পান করলে বিভিন্ন রোগ মুক্তি থেকে ভালো হয় বলে বিশ্বাস। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসেন এটি দেখতে। এখানে নামাজ পড়তে অনেক লোকজন আসেন। কিন্তু জায়গার অভাবে অনেক কষ্ট হয়। এটাকে যদি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে সংরক্ষণ করে তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
মসজিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা বাবুল মিয়া বলেন, মসজিদের ভেতরের কারুকাজ খুবই নান্দনিক। পুরাতন হলেও দূর থেকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকলেও তারা কোনো দেখভাল করেন না। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে।
মসজিদের খাদেম নূরে আলম বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদ দেখাশুনা করছি। প্রতিদিনই এটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছি। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটক আসেন এখানে। টাকা-পয়সাও দান করেন তারা। এলাকাবাসী ও পর্যটকদের টাকায় এই মসজিদ চলে।
মসজিদটির খতিব মুফতি মাওলানা আব্দুল মজিদ বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এই মসজিদটি ঐতিহ্যবাহী। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ নানা মানত নিয়ে আসেন। এই মসজিদের প্রতিদিন শত শত মানুষ নামাজ আদায় করেন। জুম্মার দিন এই মসজিদে জায়গা দেওয়া যায় না। মানুষ কষ্ট করে বাইরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। এই মসজিদের বাইরেও যেন মানুষ নামাজ পড়তে পারেন সেজন্য খোলা জায়গাতে একটি ছাউনি করে দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি।
আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজী আব্দুল শুক্কুর ডিলার গত একমাস হয় মারা গেছেন, তার জায়গায় মসজিদটি এখন দেখাশুনা করছেন তারই ছেলে মোরশেদ কামাল।
তিনি বলেন, আগ্রার তাজমহলের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে এই মসজিদের। আগ্রার তাজমহল পাথরে গড়া। এটি ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীন হলেও তারা কেবল সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। এর উন্নয়নে তারা তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এর রক্ষণাবেক্ষণে আমরা স্থানীয় লোকজন দেখভাল করে আসছি।
সরাইল উপজেলা ইউএনও মোশারফ হোসাইন বলেন, সরাইলের কয়েকশ’ বছরের পুরানো আরিফাইল মসজিদ। এটি দেখার জন্য অনেক পর্যটক আসে। এর অন্যন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যাতে করা যায় সে উদ্যোগ নেওয়া হবে। মসজিদে আসার সড়ক যেহেতু সংকীর্ণ, কিভাবে প্রশস্ত করা যায়, সে বিষয়ে আমরা দেখব।