পেঁয়াজের মৌসুম শেষ, আমদানি বন্ধ আর টানা বৃষ্টিতে সরবরাহ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা দেশজুড়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন পেঁয়াজের দাম। ৩১ জুলাই খুচরা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৫৫ টাকা। এর একদিন পর ১ আগস্ট কেজিপ্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি হয় ৬০ টাকা। সেই পেঁয়াজ ৮ আগস্ট শুক্রবার বিক্রি হয় ৮৫ টাকায়। রোববার তা ঠেকে ৯০ টাকায়। সাইদুর রহমান নামে একজন ভোক্তা যুগান্তরকে বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে এই অরাজকতা চলেছে গত ১৫-২০ বছর ধরে। এখনো সেই পুরোনো সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয় বলেই এভাবে নিজেদের খামখেয়ালিমতো পেঁয়াজের দাম নিজেদের ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেয়। পাইকারি কিংবা খুচরা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির কোনো সংকট না থাকলেও ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি দাম। এমন বাস্তবতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্য-পেঁয়াজের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার অংশ হিসাবে এবং আমদানি সচল করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রোববার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিবছর একই প্রক্রিয়ায় পেঁয়াজে মূল্য কারসাজি করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছেন। তবে এর কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পাশাপাশি ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে তদারকি সংস্থাগুলোর কোনো গবেষণা নেই। নেই কোনো বাজার তদারকির পরিকল্পনা। ফলে বছরের পর বছর বাজারে ভোক্তার অস্বস্তি বাড়ছে। তাই সরকারের উচিত হবে বাজারে নজর দেওয়া। পাশাপাশি ভোক্তা স্বস্তিতে রাখতে সংস্থাগুলোর কাজ করা দরকার।
রোববার রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি আড়ত ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদিন প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৬০ টাকা। এতে কেজিপ্রতি দাম হয় ৬৮-৭২ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগেও প্রতি পাল্লা ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এতে প্রতি কেজির দাম হয় ৫০ টাকা। সেক্ষেত্রে পাইকারি পর্যায়ে পাল্লাপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৯০-১১০ টাকা। আর কেজি হিসাবে পাইকারি পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৮-২২ টাকা।
রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার, রামপুরা বাজারসহ একাধিক খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা। যা ৭ দিন আগেও ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া এই একই পণ্য দুই সপ্তাহ আগে দাম ছিল ৫৫ টাকা।
নয়াবাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. আল আমিন যুগান্তরকে বলেন, গত দুই সপ্তাহ আগ থেকেই আড়তদাররা পাইকারি পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন, বৃষ্টির কারণে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মৌসুমও শেষ, সঙ্গে বন্ধ আমদানিও। এতে বেড়েছে দাম। কিন্তু আড়তে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। প্রত্যেকটি আড়তে থরে থরে সাজানো আছে বস্তাভর্তি পেঁয়াজ। কিন্তু দাম বেশি। তাই বাড়তি দামে কিনে এনে বাড়তিতে বিক্রি করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে পেঁয়াজের বাজার গত এক সপ্তাহ ধরে অস্থির। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ভালোমানের পেঁয়াজ প্রতি কেজি পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৫-৫৮ টাকা। এই মানের পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। মাঝারি মানের দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬৭-৬৮ টাকায়। যা ১৫ দিন আগে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর এই পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৭৮ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের বৃহত্তম পাইকারি মার্কেট হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস যুগান্তরকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। যেহেতু পেঁয়াজ কোনো দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। এ কারণে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি সপ্তাহের ব্যবধানে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। চাহিদা বাড়ার কারণে কৃষকের সংরক্ষিত পুরোনো পেঁয়াজও বাজারে ছাড়া হচ্ছে। নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করলে দাম কমবে।
পাশাপাশি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জানান, বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। এখন পুরোপুরি দেশি পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল বাজার। কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ আসছে। সম্প্রতি ভারি বর্ষণের কারণে মোকামগুলোতে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ সরবরাহ হচ্ছে না। ফলে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দিয়ে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ট্রাক ভাড়া বৃদ্ধি তথা পরিবহণ খরচ বৃদ্ধির কারণেও দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।
জানতে চাইলে রোববার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের দাম সহনীয় রাখতে তিন স্তরে তদারকি করা হচ্ছে। তিন স্তর হচ্ছে- কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যয়ে। তদারকি কালে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্যাশ মেমো রাখতে বলা হয়েছে। এই তিন স্তরে মূল্য পর্যালোচনা করে দেখা যাবে কারা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া দেশে পেঁয়াজের মূল্য সহনীয় রাখতে আমদানি সচলের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে।