টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আগামীকাল শুক্রবার শুরু হচ্ছে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা। তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবারের ইজতেমা। প্রথম আর দ্বিতীয় পর্ব আয়োজন করছে শূরায়ে নেজাম (মাওলানা যোবায়েরপন্থিরা)। এরই মধ্যে ইজতেমা ময়দানের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
তাবলিগ জামাতের জিম্মারা গত মঙ্গলবার ময়দানে আসা শুরু করেন। আসছেন সাধারণ সাথিরাও। তবে এবার তৃতীয় পর্বে সাদপন্থিদের ইজতেমা ঘিরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী বছর থেকে টঙ্গীর ময়দানে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা ইজতেমা আয়োজন করবেন না– এই শর্তে সরকার তৃতীয় পর্বের সময় নির্ধারণ করলেও বিষয়টি অনিশ্চিত। সাদপন্থিদের অভিযোগ, সরকার তাদের ওপর অনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে হেফাজতে ইসলামের প্ররোচনায়। তারা সরকারের কাছে লিখিতভাবে কোনো অঙ্গীকার করেননি।
ইজতেমার দুই পক্ষের অংশগ্রহণ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘৩১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমার দুটি পর্বে যোবায়েরপন্থিরা অংশ নেবেন। সাদপন্থিরা ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমা আয়োজন করবেন। আগামী বছর থেকে সাদপন্থিরা ইজতেমায় অংশ নেবেন না বলে তাদের দুই পক্ষের বৈঠকে সমাঝোতার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
তাবলিগ জামাতের শূরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, ‘এবার ইজতেমা সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক মুসল্লির সমাগম হবে বলে আমাদের ধারণা। আমরা প্রথম দুটি পর্বে অংশগ্রহণ করব। তবে শর্ত না মানলে সাদপন্থিদের তৃতীয় পর্বের ইজতেমার নিশ্চয়তা নেই।’
মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের ইজতেমা ৭ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ইজতেমা করার একটি বার্তা পেয়েছি। সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের মাওলানা মামুনুল হকদের প্ররোচনায় সরকার আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করে অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে আগামী বছর থেকে আমাদের ইজতেমায় অংশ না নেওয়ার শর্তে তৃতীয় পর্বের সময় নির্ধারণ করেছে। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে আমাদের না দিলে আমরাও লিখিত দেব না।’
২০১৮ সালে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে দু’পক্ষের ইজতেমার সময় নির্ধারণ করা হয়। গত নভেম্বরে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শূরায়ে নেজামের আয়োজনে প্রথম পর্ব এবং ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি সাদপন্থিদের দ্বিতীয় পর্বের সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সংঘর্ষের পর সাদপন্থিদের ইজতেমা অনিশ্চিত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সরকার ইজতেমা নিয়ে দু’পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করলেও লিখিত বা প্রজ্ঞাপন দিয়ে নতুন কোনো সময় নির্ধারণ করেনি। তবে মন্ত্রণালয় ও তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ সূত্রে জানা যায়, শূরায়ে নেজামের অধীনে ৩১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ধাপ। ৩ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তৃতীয় ধাপের ইজতেমার আয়োজন করবেন সাদ অনুসারীরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমা। ১৮ ফেব্রুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর প্রশাসনের কাছে ময়দান বুঝিয়ে দেবেন সাদ অনুসারীরা। তবে এখনও সাদপন্থিদের ইজতেমা অনিশ্চিত।
যোবায়েরপন্থিদের দাবি, সাদপন্থিরা আগামী বছর ইজতেমায় অংশ নেবেন না– এমন শর্তে মন্ত্রণালয় তৃতীয় পর্বের সময় দিয়েছে। তারা শর্ত মানার নিশ্চয়তা না দিলে তৃতীয় পর্বের ইজতেমায় তাদের অংশগ্রহণ হবে না। সাদপন্থিরা বলছেন, মন্ত্রণালয় থেকে তাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, আগামী বছর তারা ইজতেমায় অংশ নেবেন না– এমন লিখিত দিলেই এ বছর তৃতীয় পর্বের ইজতেমার সুযোগ দেওয়া হবে। তারা এখন পর্যন্ত সরকারকে লিখিত কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি।
তাবলিগ জামাতের বিশ্ব মারকাজ ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’-এর শূরায়ে নেজামকে (পরিচালনা পর্ষদ) কেন্দ্র করে দুই পক্ষে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শূরায়ে নেজাম ভেঙে দিয়ে নিজেকে আমির ঘোষণাকারী মাওলানা সাদ কান্ধলভির তাবলিগ জামাতের বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে বক্তব্যে আরও বিভক্তি বাড়ে। এসবকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৯ সাল থেকে শূরায়ে নেজাম ও সাদপন্থিরা আলাদাভাবে দুই পর্বে ইজতেমা পালন করছিলেন। সেই সময় থেকে ইজতেমা ময়দানে মাওলানা সাদ কান্ধলভি অনুপস্থিত ছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাদ কান্ধলভির ইজতেমা ময়দানে উপস্থিতি প্রশ্নে দুই পক্ষে আবার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
গত মঙ্গলবার ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বেশির ভাগ অংশে টানানো হয়েছে চটের শামিয়ানা। তৈরি হয়েছে বয়ান মঞ্চ। বয়ান মঞ্চের কাছে বিদেশি মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বয়ান মঞ্চের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাশে শামিয়ানা, শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক বিশেষ ছাতা মাইক ও বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়েছে। মুসল্লিদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া সেতু থেকে টঙ্গী সেতু পর্যন্ত তুরাগ নদে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা পাঁচটি পন্টুন সেতু নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া ফেরিঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এ ছাড়া ইজতেমা ময়দানে সিসিটিভি স্থাপন করেছে র্যাব। ময়দানের মাঝখানে নোয়াখালী থেকে আসা একদল মুসল্লি মঙ্গলবার নিজেদের জায়গা তৈরি করছিলেন। আবদুল্লাহ নামে একজন বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ইজতেমা শুরুর দুই থেকে তিন দিন আগেই চলে আসি। আগে না এলে ঠিকঠাক জায়গা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া মাঠ প্রস্তুতির কাজও করতে হয়।’