আখতার হোসেন একজন দৃঢ়চেতা, আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতিক হিসেবে ছাত্রাবস্থা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই তার সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা শুরু হয়। ২০১৮ সালে ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় অনশন ও অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি সবার দৃষ্টি কাড়েন। তার দৃঢ় অবস্থানের ফলে প্রশাসন বিতর্কিত সেই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণে বাধ্য হয়।
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে সমাজসেবা সম্পাদক পদে ছাত্রলীগ-সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করে তিনি বিজয়ী হন, যা ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ২০২১ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং শিক্ষার্থী ও জনস্বার্থে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন আদর্শবান ও কার্যকর নেতারূপে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে দীর্ঘ ৩৬ দিনের ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান- এই সময়ে তিনি নির্দলীয় ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন, যা তাকে আরও একবার ছাত্রজনতার আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ব্যক্তিগত মোহ ও স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করে রাজনীতিতে তিনি তৈরি করেছেন ভিন্নধারার এক পরিচিতি। রাজনৈতিক অঙ্গনেও রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।
রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের সদরা তালুক গ্রামের আব্দুস সালাম ও রোকেয়া বেগমের সন্তান আখতার হোসেন। রংপুরের ভায়ার হাট পিয়ারিয়া ফাযিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও ধাপ-সাতগড়া বায়তুল মুকাররম মডেল কামিল মাদ্রাসায় আলিম সম্পন্ন করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন তিনি। একবারে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা এই তরুণ বাংলাদেশের একটি অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক সংগঠনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতার পথটি কুসুম-কোমল ছিল না আখতার হোসেনের জন্য। একাধিকবার জেল-জুলুম, হামলা, মামলা, নির্যাতন ও জীবনহানির শঙ্কার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল। তারপরও শক্ত হয়ে লড়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন দেশের মাটি ও মানুষের নেতা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আখতার হোসেন আন্দোলনের নেতৃত্ব, ভেতরের নানা ঘটনা, নির্যাতন, কারাভোগ ও মুক্তি নিয়ে তার নানান অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেন।
আন্দোলনের শুরুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আখতার হোসেন বলেন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা ছিল একটি গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক দাবি-আন্দোলন। ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা কখনোই সম্পূর্ণ কোটা বাতিল চাননি; বরং যুগোপযোগী সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ, অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কিছু অংশে কোটা সংরক্ষণের যৌক্তিকতা তখনও ছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তড়িঘড়ি করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে কোটা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণা দেয় এবং পরবর্তীতে তা পরিপত্র আকারে জারি করে। তখন থেকেই আমাদের মধ্যে আশঙ্কা ছিল, এ সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ভিন্নমুখী রায় আসার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেটিই বাস্তব হয়ে দেখা দেয়।
২০২৪-এ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪-এ সরকার আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরো বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হলেন। ২৪-এর আগের ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, সড়ক আন্দোলন বা আবরারর ফাহাদের হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের ক্ষমতাকাঠামোর যে সামান্য চিড় ধরেছিল সেটা সারতে তারা পরবর্তীতে মরিয়া হয়ে উঠে। যে পরিস্থিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলো সেটাকে ২৪ -এ ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন।
ঠিক একইপন্থায় হাইকোর্টে রিট করে তারা কোটা ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেসেদিনের ৫ জুন যখন রায় ঘোষণা করা হয় তখন আমি আমার ল’ চেম্বারে কাজ করছিলাম। ফেসবুকে ঢুকে জানতে পারি। ঠিক সে সময়টাতে এটা যে একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও আমাদের শিক্ষার্থীদের ত্যাগের বিনিময়ে যে অর্জন এসেছিল তার সাথে প্রতারণা করা হলো। সে বিষয়ে ফেসবুকে লিখতে দেখি।
আমার তৎকালীন সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করিএরমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক আমার কাছে আসেন সেখানে তারা কোটা বিষয়টাই সরকারের ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে কথা বলেন। তখন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নাহিদ, আসিফ, আবু বাকের মজুমদারসহ কথা বলে ক্যাম্পাসে একটি প্রতিবাদ বিক্ষোভ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেই। তখনই আমাদের মধ্যে ভাবনা আসে, যে যতটুকু সম্ভব, সাধারণ শিক্ষার্থী এবং যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সোচ্চার ছিলেন—তাদের সবাইকে একত্র করে সম্মিলিতভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া দরকার। সেই চিন্তা থেকেই আমরা সেদিন সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি।
রাজনৈতিক কারণেই আন্দোলনের শুরুতে সামনে না থেকে পেছন থেকে কাজ করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আখতার হোসেন বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাসে আমার দীর্ঘদিনের একটি রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল—ছাত্রলীগ বিরোধী, ভারত বিরোধী এবং সরকারের সমালোচনায় সোচ্চার একজন ছাত্রনেতা হিসেবেসেই প্রেক্ষাপটে সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিলে সরকার সহজেই এটিকে রাজনৈতিক রঙ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যেত। তাই আমি বিক্ষোভে সরাসরি অংশ না নিয়ে, বিক্ষোভ শেষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় একটি খোলা সভা হয়, যেখানে আমি পাশেই অবস্থান করি।
তিনি আরও বলেন, ওই সভা শেষ হওয়ার পর আমরা একটি ক্লোজড মিটিং করি—যেখানে আমি, নাহিদ, মাহফুজ, আসিফ, বাকেরসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলামসেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, এই আন্দোলন দলীয় ব্যানারে না হয়ে সার্বজনীনভাবে পরিচালিত হবে, যাতে যে কেউ—যে এই দাবির সঙ্গে একমত—আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারে। আমাদের কৌশল ছিল, শুরুতেই যেন সরকার এটিকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে দমন করতে না পারে। তাই আমি নিজেই আন্দোলনের সামনের সারিতে না থেকে পেছন থেকে এবং আশপাশে থেকে সংগঠক হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই এবং সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করি।
আন্দোলন সংগঠিত করার সময়কার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ছাত্রনেতা আখতার হোসেন বলেন, জুন মাস থেকেই আমরা ক্যাম্পাসে আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করি। তখন ঈদের সময় ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে একটি আল্টিমেটাম দেওয়া হবে—যাতে সরকার হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে কোটা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করে এবং পূর্বের সংস্কার বহাল রাখে।
এই সময় আমরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে যারা ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন, তাদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করি। চেষ্টা ছিল, একটি কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বা সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একইসঙ্গে আন্দোলন সংগঠিত করা যায়। সেই অনুযায়ী আমরা একটি কাঠামো নির্মাণে কাজ করি।
আখতার হোসেন বলেন, পরে জুলাই মাসে সর্বাত্মকভাবে আন্দোলন শুরু হয়। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নামতে থাকেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, যখন কোনো মিছিল হলপাড়া দিয়ে অগ্রসর হতো, তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হল গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতো। বহু উত্তপ্ত পরিস্থিতি পেরিয়ে আমাদের শুরুর দিকের মিছিলগুলো হল এলাকা অতিক্রম করে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেত। একপর্যায়ে আমরা শাহবাগে গিয়ে অবস্থান নিতে শুরু করি।
অবস্থান থেকে অবরোধ কর্মসূচির বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, একটা সময় বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি আসে এবং সে কর্মসূচি শাহবাগ থেকে ধীরে ধীরে ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড় হয়ে সেটা ফার্মগেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এক্সপ্রেস হাইওয়ে পর্যন্ত এটার ব্যাপ্তি ছড়াতে থাকে ধীরে ধীরে। ততদিনে আসলে বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
‘আন্দোলন ১৪ জুলাই একটি নতুন মাত্রা পায়। সেদিন বিদেশ থেকে ফিরে শেখ হাসিনা যে প্রেস কনফারেন্স করেন, সেখানে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকারের নাতি/বংশধর হিসেবে হেয় প্রতিপন্ন করেন। ‘যে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তো রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ — এই বক্তব্য তিনি প্রদান করেন। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার বর্ণনায় আখতার হোসেন বলেন, প্রথমে হলগুলোতে পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে?—রাজাকার! রাজাকার!’—এই ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে মেয়েদের হলে প্রবেশের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর, রাতের বেলায় হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী তাদের হল থেকে বেরিয়ে আসেন। এরই মধ্যে ছাত্রদের হল থেকেও অনেক শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যের দিকে ছুটে যান। ১৪ জুলাই রাতের সেই মুহূর্তে শিক্ষার্থীরা একত্রিত হলে, স্লোগান ওঠে—‘তুমি কে আমি কে?—রাজাকার! রাজাকার!—এভাবে প্রতিবাদের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে।
সেইদিন রাতে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের অবস্থান নিয়ে এ ছাত্রনেতা বলেন, সেইদিন রাতে মিছিল ভিসি চত্বর ঘুরে আবার যখন রাজু ভাস্কর্যে ফিরে যাবে, তখন আমাদের কাছে খবর আসে যে ছাত্রলীগ পিজি হাসপাতালের একটু দূরে, ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে জড়ো হতে থাকে, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকে এবং যেকোনো সময় তারা এখানে আক্রমণ করতে পারে। রাতের বেলা এবং ছাত্রলীগের বর্বরতম আক্রমণের নজির অতীতে রয়েছে। সব মিলিয়ে, সে রাতে আন্দোলন স্থগিত রেখে পরের দিন দুপুর বেলা থেকে আবার আন্দোলনের ঘোষণা আসে।
পরদিন ছাত্রলীগের পাল্টা-কর্মসূচি ও হামলার ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ ঠিক যে সময়টাতে, সেই একই জায়গায় কর্মসূচি দেয়। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীরা সেখানে একত্রিত হয়। এক পর্যায়ে মিছিল নিয়ে সূর্যসেন হলের সামনে গেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। সেই বর্বরতম হামলায় নারী শিক্ষার্থীদের তারা রক্তাক্ত করে। সেদিন আমরা অনেকের রক্তাক্ত চেহারা দেখতে পাই। ভিসি চত্বরের হামলায় সেই মিছিল স্থগিত হয়ে যায়।
পরে আমরা যখন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম, আমাদের বোনদের দেখি রক্তাক্ত অবস্থায়। একটা ছবি অনেক ভাইরাল হয়—একজন নারী শিক্ষার্থীর কাঁধে ব্যাগ ছিল এবং তাকে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছিল। আমাদের আরেক ভাই ছাত্রলীগের কর্মীদের আক্রমণের স্থান থেকে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসে। এই রকম অসংখ্য স্মৃতি আমাদের এই হামলার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। আসলে এগুলো সারাদেশের শিক্ষার্থীদের আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও আবু সাঈদের মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৬ জুলাই আমরা শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছিলাম প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিতে। ঠিক সেই সময় খবর আসে, রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সংবাদটি আমাদের গভীরভাবে মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এতোটা সাধারণ, সাংবিধানিক অধিকার ভিত্তিক দাবি—যেটা কোনোভাবেই ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে না—সেই দাবিতেই একজন নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও অমানবিক ছিল। সেদিন রাতেই আমরা জানতে পারি, পুলিশের গুলিতে আরও ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। সেই মুহূর্তে আমাদের হৃদয়ে শুধু শোক নয়, তীব্র ক্ষোভও জন্ম নেয়—একটি ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ দাবিতে এমন প্রাণহানির ঘটনা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না।
ঢাবিতে গায়েবানা জানাজা আয়োজনের বিষয়ে এই ছাত্রনেতা বলেন, এর পরদিন আশুরার দিন ছিলো। এতোগুলো মানুষ হত্যার প্রতিবাদে সেইদিন রাজু ভাস্কর্যে একটা গায়েবানা জানাজার আয়োজন করা হয়, সেইদিন সকালে আসিফ মাহমুদ আমাকে ফোনে দায়িত্ব দিলেন আগের দিন নিউ মার্কেট এবং ঢাকা কলেজের এই জায়গায়টা একজন শহীদ হয়েছিলেন তার মরদেহ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা যায় কিনা। ক্যাম্পাস থেকে হাসপাতালে গিয়ে আমি মৃত শিক্ষার্থীর স্বজনদের সাথে কথা বলি। তারা আশাবাদী ছিলেন যে মরদেহ ক্যাম্পাসে এনে ¯সম্মানের সাথে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে, গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতির কারণে তারা অত্যন্ত ভীত ছিলেন—তাদেরকে ক্রমাগত ভয় দেখানো হচ্ছিল যাতে মরদেহ ক্যাম্পাসে আনা না হয়।
দীর্ঘ চেষ্টা সত্ত্বেও, আমরা পরিবারের নিরাপত্তা ও শান্তির কথা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসি। পরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দুপুর ২টার কাছাকাছি সময়ে আসিফ মাহমুদের সাথে কথা বললে তিনি আমাকে ক্যাম্পাসে আসতে বলেন। আমি ক্যাম্পাসে আসার সময় দেখি শেখ রাসেল ভবনের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। পুলিশ কাউকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আমি বাকবিতন্ডায় পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিচয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। তখন টিএসসিতে পুলিশে অনেক সদস্যকে দেখতে পাই। সেখানে কিছুক্ষণ আগে শিক্ষকদের কর্মসূচি ছিলো। সেটাও সমাপ্ত হয়ে গেছিলো। পরে আমি টিএসসি ভবনের উপর থেকে রাজু ভাস্কর্য দেখছিলাম। তখন কিছু সাধারণ মানুষের উপস্থিতি দেখতে পাই। জানাজায় অংশগ্রহণের মানসিকতা নিয়ে অনেকের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। দুইটা বেজে গেছে কিন্তু আসলে জানাজার মত প্রস্তুতি এখনো সেখানে নেই। সে সময়টাতে যাতে যারা এসেছেন তারা যাতে একটা ভরসা পান যে কর্মসূচিটা এখানে অনুষ্ঠিত হবে। সে কারণে আমি রাজু ভাস্কর্যের সামনে যাই। সেখানে ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম ছিলেন। তারা একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলেন।
গ্রেফতার হওয়ার সময়ের ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ রাজুতে কাউকে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। আমি সেখানে জানাজা পড়বোই বলে সংকল্প করে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি। এমন সময়, পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেলে। তারা আমাকে ক্যাম্পাস থেকে চলে যেতে বলে। ইতিমধ্যে সেদিন ক্যাম্পাসে মোবাইল নেটওয়ার্ক ডাউন ছিল। আমি কারো সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পারছিলাম না। পরে জেনেছি যে, ওই সময়টাতে শিক্ষার্থীরা হল পাড়ায় সংগঠিত হচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়টা ছিল না। কারণ মোবাইলে নেটওয়ার্ক ছিল না। তো পুলিশ যখন আমাকে ঘিরে ফেলে, তখন আমি পুলিশের আমাকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বলা নির্দেশের প্রতিবাদ করতে থাকি যে, ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের এবং আমরা এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী। এই ক্যাম্পাস আমাদের। এই ক্যাম্পাস থেকে আমরা বের হবো না তখন পুলিশ আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে । আমি রাস্তায় শুয়ে পড়ি এবং এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে থাকি। তখন আমার সাথে আরো দুই তিনজন রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলেন। আমি তখন বলতে থাকি- আমাদের জীবন আছে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ক্যাম্পাস ছাড়বো না। আমাকে কেউ ক্যাম্পাস ছাড়া করতে পারবে না।
পুলিশ তখন আমার মাথার কাছে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। কয়েকজন আহতও হোন। এরমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। তখন পুলিশ চার হাত পা ধরে চ্যাংধোলা করে তারা আমাকে প্রিজন ভ্যানে উঠিয়ে নেয়। প্রিজন ভ্যান থেকেই আমি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাই যাতে এদেশের সাধারণ মানুষরা সকলেই যেন এই আন্দোলনে শরিক হয় এবং ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে আমাকে শাহবাগ খানায় নিয়ে এসে ভিতরে প্রবেশ না করিয়ে সরাসরি রমনা থানায় নিয়ে আসে। আমাকে থানার গরাদে রাখা হলো এবং মামলা দিয়ে কোর্টে উঠিয়ে দুই দিনের রিমান্ডে শাহবাগ থানায় পাঠালো। আমি যখন শাহবাগ খানার গরাদে, সে গরাদ থেকে শাহবাগ খানার গেট হয়ে সামনে রাস্তাটা দেখা যায়। সেইদিন শাহবাগ থানার সামনে গিয়ে যত মানুষ গিয়েছেন তাদেরকে সেখানে অবস্থান নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তাদেরকে হেনস্তা করেছে। অনেককে তারা মারধর করে শাহবাগ থানায় নিয়ে এসেছে। আমি দেখতে পেলাম আমার ডিপার্টমেন্টের বন্ধু মোল্লা ফারুক ইহসানকে মারতে মারতে শাহবাগে নিয়ে আসা হচ্ছে। এরকম আরো অসংখ্য মানুষকে সেদিন রক্তাক্ত অবস্থায় শাহবাগ থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশ তাদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করেছে কাউকে কেউ কাউকে আবার ছেড়ে দিয়েছে। এত ভয়ঙ্কর
জেলখানার প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা ও নানা শঙ্কার কথা তুলে ধরেন জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হলো এবং সেখানে নির্জন কারাবাসের জন্য তৈরি করা কনডেম সেলগুলোতে আমাদেরকে রাখা হল। কনডেম সেল সাধারণত একজনের জন্য তৈরি কিন্তু আমাদের পাঁচ-ছয় জন করে বন্দিকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমরা কোনভাবেই রুম থেকে বাইরে বের হতে পারিনি এবং আমাদের জেলখানার সময়টাতে আমরা কোনভাবেই আমাদের পরিবারের কোন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। জেলখানায় একজন বলছিল এখানে অনেক শিশুদের ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। যাদের বয়স ১২-১৪ বছর। অনেককে মেরে রক্তাত্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল। খুব অসহায় অবস্থায় ছিল। নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। পরিবারের সাথে কারো কোন যোগাযোগ নেই। আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মানবাধিকারহীন অবস্থায় আমাদেরকে যেখানে রাখা হয়েছে। সে সময়টাতে বাইরে কি ঘটছে এর কোন খবরাখবর আমাদের কাছে পৌঁছাতো না। তো নতুন যে বন্দীরা আসতেন বা যাদেরকে নতুন মামলা দেয়ার জন্য আবার কোর্টে নেয়া হতো তাদের মাধ্যমে আমরা কিছু ভাঙ্গা ভাঙ্গা খবর পেতাম। শুনতাম যে, ছয় সমন্বয়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্
কবে থেকে এই খবর পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা জুলাইয়ের শেষ দিন। তার মানে প্রথম ১০-১২ দিন কোন খবর পাইনি। ১৭ জুলাই থেকে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোনভাবেই কোন খবর পাইনি। এ সময়টা পরিবার কেমন আছে? আন্দোলনকারীরা কেমন আছে তা জানার খুব ইচ্ছা করতো। কিন্তু কোনভাবেই তা পেতাম না। ভিতরে আমরা বন্দিরা আমরা কেমন আছি না আছি বা আমাদের পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন না আছেন- এটা যখন আমরা কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। যেটা একজন বন্দির অধিকার। এমন অনেক বন্ধী আছেন যারা এক কাপড়ের জেলখানায় এসেছেন এবং তাদের আসলে গোসল করার পরে কাপড় পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না।
আমরা যে জেলখানায় আছি। ঠিক কোন জেলখানায় আছি? কেমন আছি? এর কোন কিছুই আমাদের পরিবারের কেউ জানে না বা আমাদের পরিবারের কারো উপরে কিছু হলো কিনা বা আমাদের যে সাথীরা আন্দোলন করছে, আমাদের যে সহযোদ্ধা আন্দোলন করছে তারা আসলে কি অবস্থায় আছেন, তারা বেঁচে আছেন না গ্রেফতার হয়েছেন, আহত অবস্থায় আছেন না মারা গেছেন-এর কোন খবর তখন আমাদের কাছে আসে না। তখন আমরা শুধু দিনের পর দিন সেখানে অসহায়ের মত অপেক্ষা করেছি যে কবে আমরা মুক্তি পাব! তখন সবার মধ্যে একটা চাওয়ার জায়গা তৈরি হয়ে গেছে যেকোনভাবে হাসিনা থেকে মুক্ত হতে হবে। আমরা পাঁচ তারিখের দুই-একদিন আগে দুপুর বেলা আমাদেরকে আধা ঘন্টার জন্য একটু হাঁটতে দেওয়া হতো। আমাদের ফ্লোরের করিডোরে অপরপাশের বন্দিদের সাথে আমাদের কথাবার্তা হতো। আমরা কাগজে কিছু লিখে রাখতাম।
৫ আগস্টের জেলখানার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এই রাজবন্দি বলেন, ৫ আগস্ট দুপুরের পর হঠাৎ এসে আমাদের জানানো হলো, জেল সুপার আসছেন। আমরা সবাই নিজ নিজ সেলে ফিরে যাই। এরপর দেখি, কারারক্ষীরা—যারা সবসময় পাহারায় থাকেন—তারা কেউ সামনে নেই। চারপাশে এক ধরনের সুনসান নীরবতা। কী হচ্ছে, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একসময় আমাদের কানে আসে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। কিন্তু খবরটা কতটা সত্য, কতটা নির্ভরযোগ্য—তা যাচাই করার কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না। বিকেল বেলায় হঠাৎ জেলখানার এক প্রান্ত থেকে স্লোগান ভেসে আসে—‘হই হই, রই রই, শেখ হাসিনা গেল কই!’ মুহূর্তেই তা পুরো জেলখানায় ছড়িয়ে পড়ে। বন্দিদের মধ্যে এক ধরনের কম্পন ও উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। তারা থালা-বাটি লোহার গ্রিলের সঙ্গে বাজিয়ে শব্দ সৃষ্টি করতে থাকেন। চিৎকার, উল্লাস আর গগনবিদারী স্লোগানে জেলখানার নীরবতা মুহূর্তেই ভেঙে যায়। তখনই আমরা বুঝতে পারি, এমন সংবেদনশীল ও নিঃশব্দ জায়গায় যদি এই রকম সমস্বরে সবাই ‘শেখ হাসিনা পালিয়েছে’ বলে স্লোগান দেয়—তা হলে নিশ্চয়ই কোনো বড় পরিবর্তন ঘটেছে। শেখ হাসিনার পতন সত্যি হয়েছে—এই বিশ্বাস আমাদের মধ্যে দৃঢ় হয়। আমরা তখনো বন্দী, সেল থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সেলের সামনেই কিছু খালি জায়গা, আর অপর প্রান্তে আরও কিছু সেল—সেগুলোর দুএকটি দেখা যেত। আমরা মুখোমুখি হয়ে কথাবার্তা বলতাম। সেই সময় আমরা অনেক লেখা লিখেছি। আমি নিজেও কয়েকটি লেখা লিখি এবং সেগুলো পাঠ করে অন্যদের শুনাতাম। বন্দিদশার মধ্যেও লেখালেখি আর সংলাপই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
জেল থেকে বের হওয়ার ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, রাত্র ১১ টার দিকে জেলখানার দুইজন কর্মকর্তা এসে আমাকে রুম থেকে বের হতে বলে। তখন আমার মধ্যে একটা শঙ্কা ও ভয় সঞ্চার হয়। বাংলাদেশে জেলহত্যার মত ঘটনা অতীতে ঘটেছে। আমি তার থেকে সময় চেয়ে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হই। যখন আমাকে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন ওটা জেলখানার সবাই শুনছেন। তারা আমাকে আমার পরিচয় দিয়েই আখতার হোসেন, ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক সম্পাদক এই পরিচয় দিয়েই তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগটা করেছেন। সেখানে আমাকে যখন বের করে নিয়ে আসা হয় তখন আমার মধ্যে একই সাথে দুইটা বিষয় কাজ করছিল। একদিকে ভালো খবর অন্যদিকে ভীতির সঞ্চার হয়। আমি মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তত করেছি-যেকোন ধরনের পরিস্থিতি আসুক না কেন সেটাকে বরণ করে নিতে। যখন আমাকে জেল গেটে নিয়ে আসা হলো আমি দেখলাম যে কয়েকজন কারারক্ষী ও সেনাবাহিনীর সৈনিক তারা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেখানে আমি এর আগেও দুইবার গিয়েছি তখন সেনাবহিনীর সৈনিকদের আমি সেখানে দেখিনি। যখন আমাকে অফিসে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো এবং জেল সুপার তিনি আমাকে চেয়ারে বসতে বললেন। তখন আমার ধারণা পরিবর্তন হতে শুরু করে এবং আমি চেয়ারের বিপরীতে টিভিতে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর দেখ
আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের আন্দোলনের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১৬ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। যে ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের দমন করে রেখেছিল, ভয়ভীতি, নিপীড়নের মাধ্যমে হলে হলে কর্তৃত্ব চালিয়েছে—সেই ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে হল থেকে বের করে দেয়। তারা হলগুলোকে ছাত্রলীগমুক্ত করতে সক্ষম হয়। ওই রাতটা ছিল ভিন্নরকম আনন্দের, বিজয়ের অনুভূতির। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, খোঁজ নিচ্ছিলাম—কোন হলে ছাত্রলীগের পতন ঘটেছে। একটার পর একটা হলে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হচ্ছিল, আর বাকি হলের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সাহস সঞ্চয় করছিল।
আওয়ামী লীগের বয়ান ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে অপমান করেন, তখন তার বিপরীতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। আর ১৬ জুলাই তারা যে হলগুলোকে ছাত্রলীগমুক্ত করতে প্রস্তুতি নেয়। এর মধ্য দিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটে গেছে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মোড়কে যে দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছিল, সেটার মুখোশ খুলে যায়। তারা যাকে রাজাকার বলে অপবাদ দিত, তার নাগরিক অধিকারও যেন আর থাকতো না। শারীরিক নির্যাতন বা গুম-খুনও তাদের কাছে তখন যৌক্তিক হয়ে উঠতো। শেখ হাসিনার ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যখন আন্দোলনকারীদের অধিকার খর্বের চেষ্টা হয়, তখন শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার! রাজাকার!’ এই স্লোগানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করে। ওই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় সহিংসতার পক্ষে নির্মিত যে বৈধতা, তা ভেঙে পড়ে।
হল থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়নকে আন্দোলনের সফলতা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৬ জুলাই যখন শিক্ষার্থীরা হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বের করে দিতে সক্ষম হয়, তখন এটি পুরো ছাত্র সমাজকে একটি বার্তা দেয়—ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হলে শিক্ষার্থীরাই জয়ী হবে। এই বার্তা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে ওঠে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব বলেন, পরে আমরা দেখি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে অংশ নেয়, যদিও তাদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের হার কম। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়, হল খালি করে দেওয়া হয়, শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হয় এবং এত মানুষ নিহত হয়—তখন তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নামে। এটিই আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং সফলতার দিকে এগিয়ে দেয়। পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও—যাদের সরকারি চাকরির সুযোগ কম—তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনায় না এনে আন্দোলনে অংশ নেয়। তাদের কাছে মূল বিষয় ছিল—ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান এবং খুন-গুমের বিচার।
‘এই আন্দোলনের সময় সকল স্তরের মানুষ—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, নারী-পুরুষ, ডান-বাম বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ—একত্রিত হতে পেরেছিলেন একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে: বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করা। এটাই ছিল আন্দোলনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এর আগে দেশের আর কোনো আন্দোলনে এত বিস্তৃত শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলন দেখা যায়নি।’
‘এই সময়ের আন্দোলনে যারা প্রথম সারির সমন্বয়ক ছিলেন, তারা অনেকেই বন্দি বা গুম হন। কিন্তু যেহেতু এখানে কোনো একক নেতৃত্ব ছিল না, সরকার মুখ্য কোনো ব্যক্তি চিহ্নিত করে আন্দোলন দমন করতে পারেনি। বরং দ্বিতীয় সারির নেতারা, যারা অপেক্ষাকৃত অজানা, তারা আন্দোলন চালিয়ে নিতে সক্ষম হন। এটা ছিল আন্দোলনের কৌশলের অংশ—একক নেতৃত্ব নয়, সম্মিলিত অংশগ্রহণ।’
‘বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে গুম, খুন, নির্যাতন, ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এ সবকিছুর ফলেই মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি একটি গভীর ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা মানুষ খুন করছে, মৃতদেহ পুড়িয়ে দিচ্ছে, গাড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছে, এমনকি শিশুরাও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। এসব নির্মমতা মানুষের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ জন্ম দেয়।’
‘অন্য অনেক বিপ্লব বা আন্দোলনে দেখা যায়—একটি প্রস্তুতির সময় থাকে, একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক থাকে। কিন্তু এই আন্দোলনে এমন মানুষজন রাস্তায় নেমেছেন যারা একে অপরকে চিনতেন না, কিন্তু বিপদের মুহূর্তে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গুলিবিদ্ধ আহতকে অপরিচিত কেউ তুলে নিয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। এ সময়টা আমাদের জাতিকে একসূত্রে বেঁধেছে—এটাই ছিল আমাদের বড় অর্জন।’
‘সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের মানুষ যে আর কোনো স্বৈরাচারী শাসককে সহ্য করবে না—এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। এটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেন ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের দুঃসাহস দেখাতে না পারে।’
আখতার হোসেন বলেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি নতুন জনগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে—যারা প্রতিবাদী, সাহসী, দৃঢ় মানসিকতার অধিকারী এবং যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এটি আমাদের জাতির জন্য এক বড় অর্জন।