মুসলমান এক দেহ এক প্রাণ

ধর্ম ডেস্ক , শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫






                                        
                                       

ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সংঘবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করা ইসলামের নির্দেশনা। ঐক্য ও সংহতি মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আল্লাহতায়ালা ও শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ইমানের অনিবার্য দাবি হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপন করা। তাওহিদের পর মুমিনদের যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তাকিদ দেওয়া হয়েছে তা হলো ঐক্যবদ্ধ থাকা। ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য।

এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে মুমিনগণ। তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম ও কুরআন) ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩।)

ইসলামে মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। এ সম্পর্কের ভিত্তি ইসলামের একটি স্তম্ভ, যা তাওহিদের সঙ্গে সংযুক্ত। যে কেউ তাওহিদের স্বীকৃতি দেবে সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে।

এ ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’। (সূরা হুজরাত, আয়াত : ১০।) নবী করিম (সা.) মুমিনের পারস্পরিক অবস্থাকে একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়ার্দ্রতা ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানবদেহের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয় তখন তার সব দেহে ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা। (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৮০।)

অনৈক্যের বিষয়ে সতর্ক করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন : ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, সালাত কায়েম কর এবং মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ো না। যারা তাদের দ্বীনকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছে এবং নিজেরা নানা দলে বিভক্ত হয়েছে, এদের প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়েই ব্যস্ত’। (সূরা আর-রুম, আয়াত : ৩১-৩২।)

মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং মুসলিমদের একতা ও সংহতি রক্ষা করা ইসলামের একটি মৌলিক কাজ। উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং বিভেদ ও অনৈক্য থেকে বেঁচে থাকাও ইসলামের মৌলিক কাজ। ইসলাম তাওহিদের দ্বীন এবং ঐক্যের ধর্ম। ইসলামে অনৈক্য ও বিভেদের অবকাশ নেই।

ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তা ওহিদ-এক আল্লাহর ইবাদত, এক আল্লাহর ভয়। ইসলাম আদেশ করে একতাবদ্ধ থাকার, নিজেদের ঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ ও সম্প্রীতি রক্ষা করার এবং এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার, যা উম্মাহর একতা নষ্ট করে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। ইসলামের দৃষ্টিতে কুফুর এবং পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়া হারাম ও কবিরা গুনাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চিত জেনে রাখ! এ তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহিদের উম্মাহ) এবং আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমার ইবাদত কর। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ৯২।)

বিভেদ বিচ্ছিন্নতা শুধু জিদ ও হঠকারিতার কারণেই হয়ে থাকে। বিধানের ক্ষেত্রে নবীদের শরিয়তেও ভিন্নতা ছিল, অনন্ত তাদের সবার দ্বীন ছিল এক। তারা সবাই ছিলেন তাওহিদপন্থি এবং অভিন্ন। এখানেই ইসলামের অতুলনীয় সৌন্দর্য কারও সঙ্গে জুলুম-অবিচার করা যাবে না; সবার সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে হবে। আল্লাহতায়ালার বাণী, ‘হে মুমিনগণ। তোমরা আল্লাহকে সেভাবে ভয় কর যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত এবং তোমাদের মৃত্যু যেন এ অবস্থায় আসে যে, তোমরা মুসলিম। তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভেদ কর না। স্মরণ কর যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে তখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তোমাদের অন্তরগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গিয়েছ। তোমরা তো ছিলে অগ্নিকুণ্ডের দ্বারপ্রান্তে আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তার বিধানগুলো সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হও।

তোমাদের মধ্যে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে। আর এরাই তো সফলকাম। তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং মতভেদ করেছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট বিধানগুলো পৌঁছার পর। এদের জন্যই রয়েছে ভীষণ শাস্তি। যেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে আর কতক মুখ কালো হবে। যাদের মুখ কালো হবে। তাদের বলা হবে, তোমরা কুফুরি করলে ইমান আনার পর। সুতরাং স্বীয় কুফুরির দরুন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন কর। পক্ষান্তরে যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে’। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০২-১০৭।)

ঐক্যের ভিত্তি হলো তাওহিদ। ঐক্যের অর্থ ইমান ও ইসলামের সূত্রে একতাবদ্ধ থাকা। আল কুরআনের বাণী, ‘আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর। পরস্পর বিবাদ কর না, তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চিত জেন, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন’। (সূরা আনফাল, আয়াত-৪৬।)

একে অন্যকে উপহাস করা যাবে না, নিন্দা বা মন্দ জ্ঞান করা যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও। হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। সে তার চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। সে তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেক না। ইমানের পর ফিসকের নাম যুক্ত হওয়া কত না মন্দ! যারা এসব থেকে বিরত হবে না তারাই জালিম।

হে মুমিনগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক কেননা, কোনো কোনো অনুমান পাপ। তোমরা কারও গোপন ত্রুটি অনুসন্ধান করবে না এবং একে অন্যের গিবত করবে না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটা তো তোমরা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে এবং তোমাদের মাঝে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্র বানিয়েছি। যাতে একে অন্যকে চিনতে পার। নিশ্চিত জেনো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’

ইসলামি ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু তাওহিদ, উম্মাহর জাতীয়তা ইসলাম, আর মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া ও ইখলাস। (সূরা হুজরাত, আয়াত : ১০-১৩।)

রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। তোমরা আড় পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণ করো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদ করো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ো না, দাম-দরে প্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের বিক্রয়ের মাঝে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না। হে আল্লাহর বান্দারা। আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, তেমনি সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও। (বুখারি ৫১৪০, ৬০৪৪, ৬০৬৫। মুসলিম : ২৫৬৩/২৮, ২৯, ৩০ ও ২৫৬৪/৩২, ৩৩।)

  • ইসলাম