শাহ আলী পরিবহণের একটি বাস বেপরোয়া গতির কারণে ১১ মে রাতে দুর্ঘটনার শিকার হয়। রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের কাউনিয়া এলাকায় ওভারটেক করতে গিয়ে একটি মোটরসাইকেলকে চাপা দেয় বাসটি। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান মোটরসাইকেল চালক সঞ্জয় চন্দ্র ও আরোহী বেলাল হোসেন। আর বাসটি উলটে খাদে পড়ায় এর অনেক যাত্রী আহত হন।
ফারাবি এক্সপ্রেস নামের একটি বাস ৮ এপ্রিল সকালে ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসে থাকা ৭ জন নিহত এবং ৩২ জন আহত হন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়া গতিতে চলা একটি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান তিন মোটরসাইকেল আরোহী।
শুধু রংপুর-কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়ক বা ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নয়, দেশের সব সড়ক-মহাসড়কের চিত্র একই। সারা দেশে ২২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কে চলা যানবাহনের বেশির ভাগের চালকরা আইন বা নিয়মনীতি মানতে চান না। তারা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। এছাড়া যানবাহন চলাচলে রয়েছে বিশৃঙ্খলা। সড়ক-মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহনের আধিক্য। নির্বিঘ্নে চলছে লক্কড়ঝক্কড় ও ফিটনেসবিহীন বাস। এসব কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। গত সাড়ে ৫ বছরে (২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত) দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫৯ হাজার ৫৯৭ জন। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করেছে। যানবাহনের গতির লাগাম টানতে মোটরযান গতিসীমাসংক্রান্ত নির্দেশিকা-২০২৪ জারি করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরসহ বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ চালক এসব আইনের তোয়াক্কা করেন না। সড়কে এখন সাড়ে ছয় লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করছে। তাই সড়ক পরিবহণ আইন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের ঘাটতির কথা জানিয়েছেন দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা।
সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সড়ক পরিবহণ আইন ও গতিসীমা নির্দেশিকা যথাযথভাবে পালন করা হলে এবং সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহণ আইন জানানো ও মানানোর দায়িত্ব রেগুলেটরি অথরিটির (নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ)। কিন্তু তারা সেটা যথাযথভাবে করছে না। আইন বাস্তবায়নকারী পুলিশও অনেক ক্ষেত্রে ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে। ফলে চালকদের আইন না মানার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। চালকরা দেশে আইন না মানলেও অন্য দেশে গেলে ঠিকই আইন মেনে গাড়ি চালান।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ার দায় আমাদের রেগুলেটরি অথরিটির। তাদের ব্যর্থতার কারণেই সড়কে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম যানবাহনের বেপরোয়া গতি। আর দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মহাসড়ক। প্রতিবছর শুধু দুই ঈদের সময় মহাসড়কে প্রাণ যাচ্ছে শত শত যাত্রীর। আনন্দের ঈদ মুহূর্তেই রূপ নিচ্ছে বিষাদে। ফাউন্ডেশনটির তথ্য বলছে, গত ঈদুল আজহা উদ্যাপন করতে শহর থেকে গ্রামে যাওয়া-আসার ১২ দিনে (৩ থেকে ১৪ জুন) ৩৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৬টি জাতীয় মহাসড়কে ও ১২১টি আঞ্চলিক সড়কে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) জারি করা মোটরযান গতিসীমাসংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। আর মোটরসাইকেলের ৬০ কিলোমিটার এবং ট্রাকের গতি হবে ৫০ কিলোমিটার। এছাড়া সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। অন্যান্য সড়কেও সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ গতিসীমা লঙ্ঘন করে তার ৩ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে এ গতিসীমা। কেউই মানতে চান না নির্দেশিকা।
সড়ক-মহাসড়কগুলোর নিরাপত্তার মুখ্য দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের। দেশের ৪২৪৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক এবং ৩৮১২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। তবে বিশেষায়িত ইউনিট হিসাবে প্রযুক্তি নির্ভর গুণগত উন্নয়নের সঙ্গে আরও বেশি লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার বলে মনে করছেন দায়িত্বশীলরা।
হাইওয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্রে জানা যায়, সড়কের অন্যতম সমস্যা যানবাহনের বেপরোয়া গতি। বেপরোয়া গতির যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজন স্পিডগান। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশের স্পিডগান আছে মাত্র ৩১৬টি। আরও অন্তত ৮৪টি স্পিডগান প্রয়োজন। স্পিডগানের ঘাটতির কারণে গতিসীমা লঙ্ঘন করে চলা অনেক যানবাহন পার পেয়ে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে অটোমেশন পদ্ধতিতে জরিমানা আদায় পরীক্ষামূলকভাবে কার্যকর রয়েছে। অন্যান্য জাতীয় মহাসড়কেও অটোমেশন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। পুলিশের কাছে বডিওর্ন ক্যামেরা আছে ৩৫৭টি, কিন্তু আরও ৪৪৩টি ক্যামেরার প্রয়োজন রয়েছে। রেকার আছে মাত্র ২৬টি। আরও অন্তত ৫৪টি রেকার দরকার। নেশাগ্রস্ত চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যবহার হয় অ্যালকোহল ডিটেক্টর। কিন্তু এরও ঘাটতি আছে। ২৭৮টি অ্যালকোহল ডিটেক্টর প্রয়োজন হাইওয়ে পুলিশের। ভেহিকেল স্টপারের ঘাটতি রয়েছে ২৭৮টি, সার্চলাইটের ঘাটতি ৩০০টি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এবং ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও অন্যান্য মহাসড়ক-সড়কগুলোতে নেই। এছাড়া রেকার, ফার্স্টএইড বক্স, আরএফআইডির ঘাটতি রয়েছে। এরপরও হাইওয়ে পুলিশ গত ছয় বছরে সড়ক পরিবহণ আইনে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৭৬০টি মামলা করেছে। কিন্তু কার্যত এখনো সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা।
হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল আইজি দেলোয়ার হোসেন মিঞা যুগান্তরকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করছি। পরিকল্পনামাফিক নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চালকরা গতিসীমা মানছেন কিনা তা তদারকির জন্য স্পিডগান ব্যবহার করা হয়। তবে আমাদের পর্যাপ্ত স্পিডগান নেই। যা আছে তা দিয়ে আপাতত কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে অটোমেশন পদ্ধতিতে জরিমানা করার কাজ পরীক্ষামূলক ভাবে চলছে। বিআরটিএর কানেক্টিভিটি পেয়ে গেলে এটি পুরোদমে চালু হবে। তখন এসব সড়কে শৃঙ্খলা অনেকটাই ফিরে আসবে।’