প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ৭, ২০২৫, ৯:১৬ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ৬, ২০২৫, ৪:১৯ অপরাহ্ণ
দেশের পেঁয়াজের বাজারে হঠাৎ করেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মাত্র পাঁচ-ছয় দিনের ব্যবধানে দাম কেজিতে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে রাজধানীর বাজারগুলোতে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকারকদের দাবি, সরবরাহ কম থাকার কারণে দাম বেড়েছে। তারা বলছেন, গত মাসে লাগানো মুড়িকাটা পেঁয়াজ কয়েকদিন আগের বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সরকার আমদানির অনুমতি দিলে দ্রুত দাম কমে আসবে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ আছে। এই মুহূর্তে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, এটি স্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি নয়, বরং একটি সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে, যাতে সরকার আমদানি করতে বাধ্য হয়।
ভোক্তা অধিকার কর্মীরা বলছেন, কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ কম, আর মজুতদারদের হাতে বেশি। প্রতি বছর এই সময়ে পেঁয়াজের সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানো হয়। তারা সরকারি সংস্থাগুলোকে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে সারাদেশে কী পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত আছে, তা খতিয়ে দেখা যায়।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। যদিও গত বছরের তুলনায় দাম এখনও ২২ শতাংশ কম।
আমদানিকারক ও বড় পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা ছয় থেকে সাত হাজার টন। কিন্তু বাজারে এখন যে পেঁয়াজ আছে, তা দিয়ে এই চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। মুড়িকাটা পেঁয়াজ লাগানো শুরু হয়েছে প্রায় এক মাস আগে থেকে। এখন চাষির ঘরে পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসবে। তাই আমদানির বিকল্প নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ থেকে ২৭ লাখ টন। দেশীয় উৎপাদন ৩৫ থেকে ৩৭ লাখ টন হলেও, সংরক্ষণের সময় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্রতি বছর ছয় থেকে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। বিশেষ করে ভারত থেকে সহজে ও কম সময়ে পেঁয়াজ আমদানি করা যায়, তবে বর্তমানে আমদানি বন্ধ রয়েছে।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আকাশ চন্দ্র জানান, প্রতি বছর এ সময়ে পেঁয়াজের কিছুটা সংকট থাকে। তিন-চার দিন ধরে মোকামে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে, কারণ ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে না। আমদানি না হলে দাম আরও বাড়তে পারে।
আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে। যারা আগে কিনে রেখেছেন, তাদের কাছে কিছু পেঁয়াজ আছে। আমদানির পথ খুলে দিলে দুই দিনের মধ্যে দাম কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় নেমে আসবে, অন্যথায় দাম আরও বাড়বে।
কৃষি মন্ত্রণালয় এখনই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে নারাজ। তাদের যুক্তি, এখন আমদানি করলে স্থানীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ এই মাসেই বাজারে আসবে। এখন আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করাই তাদের অগ্রাধিকার।
এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ে ইতোমধ্যে দুই হাজার ৮০০টি আইপি আবেদন জমা পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী আইপি ছাড়া এলসি খুলে পেঁয়াজ বন্দরে এনে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ভারত থেকে প্রতি কেজি ২০ রুপি দরে কেনা পেঁয়াজ কাগজে ৩০ রুপি দেখানো হয়, যাতে অর্থ পাচার করা যায়।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেন। নির্বাচন ও রাজনৈতিক চাপে থাকায় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নজর কম থাকায় ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, পেঁয়াজের আইপি বন্ধ করা হয়েছে অনেক আগে, তাই হঠাৎ করে দাম দ্বিগুণ হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. জামাল উদ্দীন বলেন, এই মুহূর্তে দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই। এটি কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
অন্যদিকে, কৃষকরা চান আমদানি বন্ধ থাকুক। তারা বলছেন, গত বছর পেঁয়াজসহ কয়েকটি ফসলের দাম না পেয়ে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই, সরকার যেন আমদানি বন্ধ রাখে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ জানান, সরকার কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থের দিকে নজর রাখছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছে এবং কৃষকদের মধ্যে উন্নত জাতের বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, পেঁয়াজ সংরক্ষণে আট হাজার ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ স্থাপন করা হয়েছে, যা পেঁয়াজের আয়ু বাড়াতে সাহায্য করছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার কিভাবে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখে এবং কৃষক ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।