একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটিতে জর্জরিত আকাশে লাল-সবুজের পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গত কয়েক মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাটির বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলো ক্রমাগত যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উড়তে গিয়ে কখনো রানওয়েতে হোঁচট খাওয়া, মাঝপথ থেকে ফেরত আসার মতো ঘটনা ঘটছে। এর ফলে বিমান ক্রাশের শঙ্কা, ফ্লাইট বাতিল, গন্তব্যে পৌঁছাতে অনিশ্চয়তাসহ যাত্রীরা পড়ছেন চরম ভোগান্তির মধ্যে।
অপরদিকে ফ্লাইট শিডিউল বিঘ্নিত হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত এই এয়ারলাইন্সটি যাত্রী কমে যাওয়াসহ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। বিমানে বারবার এমন যান্ত্রিক ত্রুটির পেছনে শুধু প্রকৌশলগত দুর্বলতা নাকি দায়িত্বশীলদের গাফিলতি ও ষড়যন্ত্র- তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, এয়ারলাইন্সের পুরো ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার প্রয়োজন। পাশাপাশি এই ত্রুটিগুলো কোনো ষড়যন্ত্র কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।
সূত্রমতে, গত এক মাসে বিমানের অন্তত ১৬টি ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়েছে। যার ফলে উড়োজাহাজ ফেরত এসেছে কিংবা ফ্লাইট বিলম্ব হয়েছে। রহস্য উদঘাটনে কর্তৃপক্ষ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সমাধান হচ্ছে না।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ত্রুটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং দীর্ঘদিনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার অবহেলার ফসল। বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে কারিগরি দক্ষতা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এসবের অভাব বিমানের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
সবচেয়ে কাছের ঘটনাগুলোর মধ্যে ১১ আগস্ট (সোমবার) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ঢাকায় ফিরে এসেছে। ১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা বিজি-৬১৫ ফ্লাইটটি। কিন্তু শিডিউল সময়ের প্রায় ১ ঘণ্টা পর ড্যাশ-৮ মডেলের (এসটুএকেই) উড়োজাহাজটি দুপুর ২টা ৩৪ মিনিটে ঢাকা থেকে উড্ডয়ন করে। মাত্র ২০ মিনিট আকাশে থাকার পর ২টা ৫৫ মিনিটে আবার ঢাকায় ফিরে আসে। উড্ডয়নের পর কেবিনের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈমানিক নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানটি ফিরিয়ে আনা হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ইতালি থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকাগামী ফ্লাইট (বিজি ৩৫৬) বাতিল করা হয়েছে। স্থানীয় সময় রোববার (১০ আগস্ট) সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফিউমিসিনো বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশে উড্ডয়নের কথা ছিল। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সূত্রে জানা গেছে, উড্ডয়নের পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও শেষ মুহূর্তে বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটির ডানার ফ্ল্যাপ কাজ না করায় ফ্লাইটটি বাতিল করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব না হওয়ায় উড়োজাহাজটি গ্রাউন্ডেড অবস্থায় বিমানবন্দরে রাখা হয়েছে। দুর্ভোগে পড়া বিমানের ২৬২ জন যাত্রীকে হোটেলে রাখা হয়েছে। লন্ডন থেকে ইঞ্জিনিয়ার ও মেশিনারিজ পৌঁছানোর পর বিমানের ত্রুটি সারিয়ে যাত্রীদের ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানা যায়।
এর মাত্র একদিন আগে, ৯ আগস্ট সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পথে ফ্লাইট বিজি-৫৮৫-এর ইঞ্জিনে ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে মেরামত শেষে ঢাকার পথে রওনা করে বিমানের ফ্লাইটটি। এ ঘটনায় ১৭২ জন যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়েন। ৭ আগস্ট ঢাকা থেকে আবুধাবিগামী বিমানের ফ্লাইট বিজি-৩২৭ পয়োবর্জ্য ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে মাঝ আকাশ থেকে ফিরে আসে। এই ফ্লাইটের এক যাত্রী আরাফাত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রথমে যাত্রীদের বলা হয় ফ্লাইট রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে ছাড়বে। কিন্তু নির্ধারিত সময়েও উড্ডয়ন হয়নি। পরে রাত ১২টার দিকে বিমানটি আকাশে উঠলেও প্রায় এক ঘণ্টা পর জানানো হয়, বিমানের তিনটি শৌচাগারের ফ্লাশ কাজ করছে না। ফলে অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর ক্যাপ্টেন ফ্লাইটটি পুনরায় ঢাকায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন।
এর আগে, বুধবার (৬ আগস্ট) আকাশে উড়তে থাকা বিমানের আরেকটি ফ্লাইটে ত্রুটি ধরা পড়ে। দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে ঢাকা থেকে ব্যাংককের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে উড়োজাহাজটি। মিয়ানমারের আকাশে প্রবেশের পর পাইলট ইঞ্জিনে অস্বাভাবিক কম্পনের সংকেত পান। নিরাপত্তার স্বার্থে দুপুর ১টা ২১ মিনিটে ফ্লাইটটি শাহজালাল বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। এ ঘটনায় ১৬টি ফ্লাইটের সময়সূচি এলোমেলো হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। যাদের মধ্যে ছিলেন বয়স্ক, অসুস্থ, শিশু এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যের যাত্রী।
এর আগে, ২৮ জুলাই দাম্মামগামী বিমানের বিজি-৩৪৯ ফ্লাইটটিও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঢাকায় ফিরে আসে। এর আগে ১৬ জুলাই রাতে দুবাই বিমানবন্দরে বিমানের একটি বোয়িং উড়োজাহাজের চাকা ফেটে গিয়ে ফ্লাইট বিঘ্নি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন ২২০ যাত্রী।
এর কয়েক দিন আগে, জুলাইয়ের শুরুতে ঢাকা থেকে উড়ে জেদ্দায় অবতরণের পর পার্কিংয়ের সময় আরেকটি বোয়িংয়ের চাকায় ত্রুটি ধরা পড়ে। উড়োজাহাজটি সেখানেই গ্রাউন্ডেড করা হয়। বিপাকে পড়েন ফ্লাইটটির ৩৮২ যাত্রী।
নিয়মিত ভ্রমণকারী যাত্রীরা বলছেন, যান্ত্রিক ত্রুটি ও ফ্লাইট বিলম্ব বিমানে এখন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রী তানিয়া হামিদ যুগান্তরকে বলেন, বিকাল ৫টার ফ্লাইট রাত ৯টা পর্যন্ত বিলম্ব হলো। অথচ বিমান থেকে সুনির্দিষ্ট আপডেট দেওয়া হয়নি। ছোট বাচ্চা নিয়ে অপেক্ষা ছিল কষ্টকর।
আরাফাত ইসলাম নামের এক বৈমানিক বলেন, আমরা পাইলটরা ফ্লাইট শেষে টেকনিক্যাল লগবুকে সব সমস্যার বিস্তারিত লিখে দেই। সেগুলো রেক্টিফাই করা ও পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য এয়ারক্রাফট সঠিকভাবে প্রস্তুত রাখা ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের দায়িত্ব। কিন্তু যদি মেরামত না করে পাইলটকে বিমান বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা শুধু অবহেলাই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলকও হতে পারে। এক মাসে ১৬টি ফ্লাইটে এমন ঘটনা ঘটলে সেইফটি ডিপার্টমেন্টেরও ব্যর্থতা প্রমাণিত হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশ বিমানসহ সব উড়োজাহাজের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আকাশ থেকে কেন ফ্লাইট ফেরত আসছে, সেই কারণগুলো বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।