প্রায় দেড়'শ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ। নবাবি আমলের স্থাপত্যশৈলীর কারণে মসজিদটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, হয়ে উঠেছে শতবর্ষী ঐতিহ্যের স্মারক। সময়ের পরিক্রমায় এটি সংস্কার হলেও ধরে রাখা হয়েছে মূল নকশা ও স্থাপত্যশৈলী।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ডস ফর কালচারাল হেরিটেজ কনজারভেশনে ‘অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয় দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ। এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের আগমন ঘটে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কোন্ডা ইউনিয়নের দোলেশ্বর গ্রামে বাংলা ১২৭৫ সনে (ইংরেজি ১৮৬৮, হিজরি ১২৮৫) দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ নিজ উদ্যোগে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ মসজিদটির নির্মাণে প্রথম উদ্যোক্তা হওয়ায় এটি ‘দারোগা মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। তাঁর ছেলে মইজউদ্দিন আহম্মদ ছিলেন মসজিদের প্রথম মোতোয়ালি। মইজদ্দিন আহাম্মদ, তমিজউদ্দিন আহাম্মদ, করিমউদ্দিন আহাম্মদ, খিদির বক্স মিয়া ও আবদুর গফুর আহাম্মদ মসজিদটির জন্য জমি ওয়াক্ফ করেন।
মসজিদের সামনে স্থাপন করা সাইনবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সহোদর খিদির বক্স ও কাদের বক্স এবং মইজউদ্দিন আহাম্মদের পরিবার বংশপরম্পরায় মসজিদটির নির্মাণ ও সংস্কারকাজে যুক্ত ছিলেন। কাদের বক্সের নাতি ও হাফেজ মো. মুছার ছেলে তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান মসজিদটির বর্ধিত অংশ ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করেন। এরপর একাধিকবার মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়। কালের আবর্তে এই মসজিদের অবকাঠামো বিলীন হওয়ার পর্যায়ে ছিল।
মসজিদটিকে সংস্কার করে পুরোনো রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেন হামিদুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের উদ্যোগে স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ মসজিদ অবকাঠামো ঠিক রেখে পুনঃসংস্কারের কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে সংস্কারকাজ শেষ হয়। পুরোনো মসজিদের পাশেই নির্মাণ করা হয় নতুন আরেকটি মসজিদ। পুরোনো মসজিদটি এখন গ্রন্থাগার ও মক্তব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদটি লাল ইটের নির্মিত, যা ঐতিহাসিক বাংলার মসজিদগুলোর প্রাচীন নির্মাণশৈলীর সঙ্গে মিল রয়েছে। মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এক গম্বুজবিশিষ্ট নকশা। গম্বুজটি উঁচু ও গোলাকৃতির। গম্বুজের চারপাশে ছোট ছোট মিনার স্থাপন করা হয়েছে।
মসজিদের প্রবেশপথে খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে, যার ওপরের অংশে সূক্ষ্ম কারুকার্য খোদাই করা। সামনের দেয়ালে ও প্রবেশপথের চারপাশেও খোদাই করা নকশা দেখা যায়। মসজিদের অভ্যন্তরের অংশটি উঁচু ও প্রশস্ত। যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া মসজিদের আশপাশে সবুজ ঘাস ও ছোট ছোট গাছের সমাহার রয়েছে। পাশেই একটি জলাধার রয়েছে, যেখানে মসজিদের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও নকশা ঠিক রেখে পুনঃসংস্কার করায় মসজিদটি ব্যতিক্রমী স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে বিশ্বদরবারে সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে। ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেসকোর এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ডস ফর কালচারাল হেরিটেজ কনজারভেশনে ‘অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া ওই মাসের ১৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবের আবদুল লতিফ ফাওজান আন্তর্জাতিক ‘মসজিদ স্থাপত্য শিল্পবিষয়ক অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত হয়ে মসজিদটি। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসেফ বিন আল-দুহাইলান মসজিদটি পরিদর্শন করেন।
দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ আসেন। ইউনেসকো ও সৌদি সরকারের পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর থেকেই মসজিদটি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে মসজিদটি দেখতে এসেছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেড় শ বছরের বেশি পুরোনো এই মসজিদের ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পেরেছেন। সেই কৌতূহল থেকে মসজিদটি দেখতে আসা। মসজিদটির নির্মাণশৈলী সত্যিই অভূতপূর্ব। এর কারুকার্য, গম্বুজ ও নকশা যে কারও নজর কাড়বে। মসজিদ শুধু কেরানীগঞ্জের নয়; বরং পুরো বাংলাদেশের জন্যই গর্বের বিষয়।
পুরান ঢাকার টিকাটুলী থেকে চার বন্ধু মিলে মসজিদটি দেখতে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের শিক্ষার্থী আয়াজ উল্লাহ বলেন, ‘দোলেশ্বর মসজিদের প্রাচীন স্থাপত্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। শত বছর পরও এর সৌন্দর্য অটুট রয়েছে। মসজিদটি যেন ইতিহাসের গল্প বলে। মসজিদটি দেখে চোখ ও মন জুড়িয়ে গেছে!’
দোলেশ্বর এলাকার বাসিন্দা আয়াতউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি এই মসজিদ দেখছি। বাংলাদেশের শতবর্ষী স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের এক মূল্যবান নিদর্শন। পুরোনো স্থাপত্যশৈলী ধরে রেখে এটি সংস্কার করায় মসজিদটির সৌন্দর্য আরও বেড়েছে। এখন অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটকও এখানে আসেন, যা আমাদের এলাকার জন্য গর্বের বিষয়।’
মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি জুমার নামাজে শত শত মুসল্লি অংশ নিয়ে থাকেন। মসজিদের ইমাম মাওলানা আবুল হোসেন বলেন, প্রাচীন ঐতিহ্য ও মসজিদের লালচে ইটের কাঠামো সংরক্ষিত রেখে মসজিদটি পুনঃসংস্কার করা হয়। অপূর্ব নির্মাণশেলী প্রাকৃতিকভাবেই মসজিদটিকে শীতল রাখে। প্রায় সময় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন।