দুর্নীতির ধারণা সূচক: লাগামছাড়া দুর্নীতি, সামলানো সম্ভব?

নিজস্ব প্রতিবেদক , বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫






                                        
                                       

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের বার্ষিক দুর্নীতি ধারণা সূচক–২০২৪ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এবার ১০০-এর মধ্যে মাত্র ২৩ স্কোর পেয়েছে, যা ২০২৩ সালের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়ে এবার ১৫১তম। ২০১২ সালের পর এবার বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। এ থেকে আমাদের জন্য তিনটি উদ্বেগজনক বিষয় উঠে এসেছে।

প্রথমত, বাংলাদেশ এখন সেই দেশগুলোর মধ্যে পড়ছে, যারা দুর্নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ ৫০-এর নিচে স্কোর পেয়েছে, তাদের ‘গুরুতর দুর্নীতিগ্রস্ত’ ধরা হয়। বাংলাদেশ সেই তালিকায় রয়েছে। তৃতীয়ত, আমাদের স্কোর বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় ২০ পয়েন্ট কম। ফলে বাংলাদেশকে ‘অত্যন্ত গুরুতর দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় ফেলা হয়েছে।

এ সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৪তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখনো নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলে শুধু আফগানিস্তান আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমরা পঞ্চম সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছি।

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকা ৫৯টি দেশের গড় স্কোরের তুলনায় ৯ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি তা জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে নিচের ৩৩টি দেশের গড় স্কোরের চেয়েও ৬ পয়েন্ট কম এবং ২০২৩ সালে ‘নাগরিক সমাজের জন্য সীমিত’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ২৭টি দেশের গড় স্কোরের চেয়েও ৬ পয়েন্ট কম। আরও লজ্জাজনকভাবে বাংলাদেশের সূচক সাব-সাহারান আফ্রিকার গড় সূচকের চেয়ে ১০ পয়েন্ট কম। অথচ সাব-সাহারান অঞ্চলকে দুর্নীতি সূচকের সবচেয়ে দুর্বল পারফরম্যান্সকারী অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়।

২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর বিশ্বব্যাপী গড় সূচক আরও খারাপ হয়েছে। বৈশ্বিক গড় হচ্ছে ৪৩। বিশ্বের ১২২টি দেশ ৫০-এর নিচে স্কোর করেছে। ১০১টি দেশ পেয়েছে ৪৩-এর কম। এর অর্থ হলো বিশ্বের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করছে এমন দেশে, যেগুলো ‘অত্যন্ত গুরুতরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত’। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান এবারও সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্য সব দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর নিচে রয়েছে—ভারত ও মালদ্বীপ ৩৮, নেপাল ৩৪, শ্রীলঙ্কা ৩২, পাকিস্তান ২৭ ও আফগানিস্তান ১৭।

ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই ২০২৩ সালের তুলনায় খারাপ করেছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দমনমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই দুই দেশই ২০১২ সালের পর এ বছর সবচেয়ে খারাপ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ছাড়া বাকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ২০১২ সালের তুলনায় কিছুটা উন্নতি করেছে। পাকিস্তানের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। এ সূচক স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই দুর্নীতির বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। বরং অনেকের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

২০২৪ সালের দুর্নীতি ধারণা সূচকের মূল বার্তা হলো দুর্নীতি শুধু একটি উন্নয়নগত চ্যালেঞ্জ নয়। এটা হলো দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের ফল। এই অপব্যবহার গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। উচ্চ স্কোর পাওয়া দেশগুলো তুলনামূলকভাবে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।

এসব দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর কালোটাকা মজুতের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এই কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো অন্য দেশগুলোর দুর্নীতির সুবিধাভোগী হয় এবং সেই অর্থ তাদের অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়।

মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীরা এ ধারণা সূচকে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তৃতীয় স্থানে থাকা সিঙ্গাপুর (৮৪), পঞ্চম স্থানে থাকা সুইজারল্যান্ড (৮০), দশম স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়া (৭৭), ১৫তম স্থানে থাকা কানাডা (৭৫), ১৭তম স্থানে থাকা হংকং (৭৪), ২০তম স্থানে থাকা যুক্তরাজ্য (৭১), ২৩তম স্থানে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত (৬৮), ২৮তম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র (৬৫) এবং ৫৭তম স্থানে থাকা মালয়েশিয়া (৫০)—এই দেশগুলোই বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার প্রধান গন্তব্য।

এটি স্পষ্ট যে দুর্নীতি দমনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নীতির মূলধারায় নিয়ে আসা জরুরি। যদি তা না করা হয়, তাহলে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের ওপর। বাংলাদেশ গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সময় দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজ পড়েছে গভীর সংকটে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতেও একই ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।

২০২৪-এর সময়কালে লুটপাটনির্ভর স্বৈরশাসন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতি রক্ষা এবং প্রসারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এ সময় সরকারি খাতে দুর্নীতি আরও তীব্র হয়। বিশেষ করে সরকারি কেনাকাটা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো, যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগ কাজ করে গেছে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন। এ পরিস্থিতিই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরশাসনের পতনের পরও ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির চর্চা অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির কেন্দ্রগুলো দখলের জন্য দলীয় গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত বিদ্যমান ছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি অব্যাহত ছিল। এসব কারণই হয়তো বাংলাদেশ দুর্নীতি ধারণার সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

এসবের সমাধান কোনো জটিল বিষয় নয়। দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে এর প্রকৃত স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার মাধ্যমে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে তারা পেশাদারত্ব ও নৈতিকতার মান বজায় রেখে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। জনস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে দখলদারত্ব, স্বার্থের সংঘাত এবং দলীয় রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এসব খাতের মধ্যে রয়েছে সরকারি কেনাকাটা, ব্যাংকিং, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি ও অবকাঠামো। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে তারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ, প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ও সরকারি পদগুলোকে ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বন্ধ হয়।