আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের গড়ে দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দুইটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাপ প্রবাহের মাত্রা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী দিনগুলোয় তাপমাত্রা ৩৩ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকতে পারে, যা তীব্র গরমের ইঙ্গিত দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীষ্মকালে, বিশেষ করে এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রীষ্মকালে দেশের গড় তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। সার্বিকভাবে এপ্রিল ও মে মাসে তীব্র গরমের সম্ভাবনা উচ্চ। তাই এই সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পর্যাপ্ত জল গ্রহণের মাধ্যমে সতর্কতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ।
তীব্র গরমের প্রধান কারণ:
নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকাগুলোয় সূর্যের কিরণ সরাসরি পড়ে, ফলে সেখানে তাপমাত্রা বেশি হয়। গ্রীষ্মকালে পৃথিবীর নির্দিষ্ট অংশ সূর্যের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে, তাই সেই অঞ্চলে বেশি গরম পড়ে।
উচ্চচাপ বলয়: যখন বায়ুমণ্ডলে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়, তখন গরম বাতাস নিচের দিকে চাপ সৃষ্টি করে এবং বায়ু শুষ্ক হয়ে যায়, ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। কিছু অঞ্চলে প্রচণ্ড গরম ও শুষ্ক বাতাস বয়ে যায়, যা তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
গ্রীষ্মকালে দিন বড় হয়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পড়ে এবং তাপমাত্রা বাড়ায়। মরুভূমি বা শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়, ফলে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গিয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়।
মানবসৃষ্ট কারণ (গ্লোবাল ওয়ার্মিং): কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। নগরায়ন ও বনভূমি ধ্বংসের ফলে তাপমাত্রা আরও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ গাছপালা তাপ শোষণ ও ঠান্ডা পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে। কংক্রিট ও স্টিলের তৈরি শহরগুলো তাপ ধরে রাখে, যা ‘Heat Island Effect’ সৃষ্টি করে।
মৌসুমী পরিবর্তন ও জলবায়ুর ভূমিকা: গ্রীষ্মকালে দিন বড় হয়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পড়ে এবং তাপমাত্রা বাড়ায়। মরুভূমি বা শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়, ফলে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গিয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়। তীব্র গরম কমানোর জন্য বৃক্ষরোপণ, পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তীব্র গরমের কারণে বোরো ধান, ফল, এবং সবজি ফসলের ওপর নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
নিচে প্রতিটির সম্ভাব্য ক্ষতির বিবরণ দেওয়া হলো—
ধান ফসলের ক্ষতি:
তীব্র গরমের কারণে বোরো ধানের শীষে ধান চিটা হয়ে যাওয়া, তীব্র তাপমাত্রার কারণে ধানের শীষে দানা কম আসতে পারে বা চিটা হয়ে যেতে পারে। গরমে পরাগায়ন ঠিকমতো না হলে দানা সঠিকভাবে পূর্ণ হয় না, ফলে চিটা ধান বেড়ে যায়।
উচ্চ তাপমাত্রায় জমির পানি দ্রুত শুকিয়ে যায়, ফলে ধানের শীষ, পেনিকেল বা ফুল গঠনের সময় পানির অভাব দেখা দেয়। যা ধানের ফলন প্রচণ্ডভাবে কমিয়ে দেয়। দিনের ও রাতে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে ধানে ব্লাস্ট বা ব্রাউন স্পট দেখা দেয়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা থাকলে ছত্রাকজনিত রোগ বৃদ্ধি পায়।
ফল-ফসলের ক্ষতি:
ফল জাতীয় ফসলে প্রচণ্ড গরমে তীব্র জলীয় বাষ্পীভবনের কারণে ফলের কোষ দ্রুত প্রসারিত হয় এবং ফাটল ধরে যেতে পারে (যেমন, লিচু, তরমুজ, আম)। অতিরিক্ত গরমে গাছের পুষ্টি শোষণ ও পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে অপরিপক্ব ফল ঝরে যায়। উচ্চ তাপমাত্রায় ফলের চিনি উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফলে স্বাদে পরিবর্তন আসতে পারে। গরমে কিছু কীটপতঙ্গ (যেমন ফলের মাছি) ও রোগ (যেমন পাউডারি মিলডিউ) বেশি দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়।
সবজি-ফসলের ক্ষতি:
পাতা ও গাছ শুকিয়ে যায়, তীব্র তাপমাত্রায় জলীয় বাষ্পীভবনের হার বেড়ে যায়, ফলে গাছ দ্রুত শুকিয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত গরমে অনেক সবজি গাছে (যেমন টমেটো, বেগুন, শসা) ফুল ঝরে যেতে পারে, ফলে ফলন কমে যায়। তাপমাত্রা বাড়লে থ্রিপস, এফিড, জ্যাসিড ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের সংখ্যা বাড়তে পারে। তীব্র গরমে ডাউনি মিলডিউ, ব্লাইট, উইল্টের মতো রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ (সেচ-স্প্রে) নিশ্চিত করা। গাছের গোঁড়ায় মালচিং (খড়, শুকনো পাতা) প্রয়োগ করা। ছায়া বা শেড নেট ব্যবহার করা। রোগ ও পোকামাকড়ের নিয়ন্ত্রণে সতর্ক থাকা। নির্দিষ্ট অঞ্চলের আবহাওয়া অনুযায়ী আরও নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করা। অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ ও পোকামাকড় দমনে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা। তাপ সহিষ্ণু জাতের চাষাবাদ করা।
উন্নত দেশে কৃষিতে উচ্চ তাপপ্রবাহ মোকাবিলা:
উন্নত প্রযুক্তির, ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতি এবং IoT, AI প্রযুক্তি ব্যবহার কারা। সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থা যা কম পানিতে বেশি ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে।
গ্রিনহাউস প্রযুক্তি: তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সুরক্ষিত পরিবেশে উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করা হয়।
প্রিসিশন এগ্রিকালচার: ড্রোন, সেন্সর ও AI ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
খরা সহনশীল ফসলের চাষ: জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে খরা সহনশীল ফসল উদ্ভাবন করা হয়। যেমন জিএমও ভুট্টা ও গম। স্থানীয় জলবায়ুর উপযোগী জাত নির্বাচন করা হয় যা কম পানি ও উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। মাটি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা।
মালচিং (Mulching): মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে প্লাস্টিক বা জৈব উপকরণ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।
কভার ক্রপিং (Cover Cropping): জমির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক উদ্ভিদ চাষ করা হয়। কনজারভেশন টিলেজ, মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য কম চাষাবাদ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। সেচ ও জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (Rainwater Harvesting) করা।
ডিসেলাইনেশন (Desalination): সমুদ্রের পানি পরিশোধন করে কৃষিতে ব্যবহার করা হয়।
স্মার্ট ইরিগেশন: কম্পিউটার ও মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় সেচ প্রদান করা হয়। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও নীতিগত সহায়তা। ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচার (CSA) নীতি গ্রহণ করা হয়। কৃষকদের উচ্চ তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সরকার ও গবেষণা সংস্থাগুলো তাপ সহনশীল কৃষির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো। নেদারল্যান্ডস, গ্রিনহাউস প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম জায়গায় বেশি উৎপাদন। ইসরায়েল, স্মার্ট ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবস্থা। অস্ট্রেলিয়া, খরা সহনশীল শস্য উদ্ভাবন ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা। উন্নত দেশগুলো এইসব প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করে উচ্চ তাপমাত্রার বিরূপ প্রভাব কমিয়ে কৃষি উৎপাদন বজায় রাখে। আমাদের দেশে উপরোক্ত প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।
উন্নত দেশে জীবনযাত্রায় উচ্চ তাপপ্রবাহ মোকাবিলা:
প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম শীতলীকরণ ব্যবস্থা: শহরজুড়ে শীতলীকরণ কেন্দ্র বা কুলিং স্টেশন স্থাপন করা হয়, যেখানে মানুষ বিনামূল্যে ঠান্ডা পানি ও শীতল আশ্রয় পায়। সরকারি ও বেসরকারি ভবনগুলোয় উচ্চ কার্যকারিতা সম্পন্ন এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।
তীব্র গরমের কারণে বোরো ধানের শীষে ধান চিটা হয়ে যাওয়া, তীব্র তাপমাত্রার কারণে ধানের শীষে দানা কম আসতে পারে বা চিটা হয়ে যেতে পারে। গরমে পরাগায়ন ঠিকমতো না হলে দানা সঠিকভাবে পূর্ণ হয় না, ফলে চিটা ধান বেড়ে যায়।
গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও পরিকল্পিত নগরায়ন: গ্রিন রুফ (সবুজ ছাদ) ও ভেজিটেটেড ওয়াল (গাছপালা দিয়ে আবৃত ভবন) তৈরি করা হয়, যা তাপমাত্রা কমায়। রাস্তায় এবং খোলা জায়গায় ছায়াযুক্ত এলাকা ও জলাধার স্থাপন করা হয়। তাপ-প্রতিরোধী রঙ ও উপকরণ দিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়, যাতে তাপমাত্রা কম থাকে।
জনসচেতনতা ও সতর্কতা ব্যবস্থা: টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তাপপ্রবাহ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। প্রচণ্ড গরমে কীভাবে সুস্থ থাকা যায়, সে সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়।
কর্মঘণ্টা ও স্কুল সময়ের সমন্বয়: তাপপ্রবাহ চলাকালীন অফিস ও স্কুলের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়। বাইরে কাজের সময় কমিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় নির্ধারণ করা হয়।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা: হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোয় হিটস্ট্রোক ও ডিহাইড্রেশন রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়। বয়স্ক ও দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ মেডিকেল চেকআপ এবং সহায়তা প্রদান করা হয়।
পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ: প্রচণ্ড গরমে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয় এবং পানির সংরক্ষণ কৌশল গ্রহণ করা হয়। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা সামাল দিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়। এই ধরনের উদ্যোগগুলো উন্নত দেশগুলোর তাপপ্রবাহ মোকাবিলার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। আমার দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশন সমূহের উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই সময়।