চিরচেনা গো-শালিক

নিজস্ব প্রতিবেদক , শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫






                                        
                                       

এ বছরের ২ আগস্ট প্রকল্পের কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, পোষা পাখির খামারি আইনজীবী রোমেল আশরাফের লাভবার্ডের খামার পরিদর্শন ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। খামারটি বেশ বড় ও পরিচ্ছন্ন। এর আগে আইন পেশায় যুক্ত থাকলেও খামারের পরিধি বৃদ্ধি ও ব্যবসায় সাফল্যের কারণে বর্তমানে পোষা পাখি পালনকেই একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নিজ বাসার তিন তলাজুড়ে খামারটি অবস্থিত। শহরের মধ্যে হলেও রোমেলের বাড়ির অবস্থান একেবারেই প্রকৃতির কোলে। বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর। সামনে আরেকটি ছোট পুকুর, যা বর্তমানে টোপাপানায় ভরা। দেখে মনে হয় যেন প্রকৃতি পুকুরটিকে কার্পেটে মুড়িয়ে রেখেছে।

প্রকল্পের কাজ শেষে বিকেলে ঢাকায় ফেরার জন্য গাড়িতে ওঠার সময় ক্ষণিকের জন্য টোপাপানার কার্পেটে মোড়ানো পুকুরের সৌন্দর্যে খানিকটা অবগাহন করার ইচ্ছা হলো। তবে পুকুরে ভাসমান টোপাপানার সৌন্দর্যের মধ্যে আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ কিন্তু খুঁজছিল অন্য কিছু। কারণ, কদিন আগে আমার কর্মস্থল গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুকুরে ভাসমান কচুরিপানার ফাঁকে আবিষ্কার করেছিলাম চারটি কুচকুচে কালো ছানাসহ এক ডাহুক মাকে। তবে মিনিট দশেক খুঁজে তেমন কিছু না পেয়ে যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই কটি চড়ুইছানা টোপাপানার ওপর এসে নামল।

টোপাপানার ওপর ছানাগুলোকে দেখতে বেশ লাগছিল! ওদের ছবি তুলতে তুলতেই একঝাঁক সাদা-কালো পাখির ছানা ওদের সঙ্গে যোগ দিল। ছানাগুলোর পালকের রং এখনো সঠিকভাবে ফুটে ওঠেনি। ইদানীং বিকেলে যখন ক্যাম্পাসে হাঁটি, তখন চিরচেনা এই পাখির ছানাগুলোকে বৈদ্যুতিক তারের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে বসে থাকতে দেখি। কিন্তু আজ যখন ওরা টোপাপানার ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে পোকামাকড় খুঁজে খাচ্ছিল, তখন বেশ লাগছিল!

গত বছরও ঢাকার আমিনবাজার পেরিয়ে বলিয়াপুর ময়লার ভাগাড়ে এই প্রজাতির কয়েক শ পাখির একটি ঝাঁকের ছবি তুলেছিলাম। ওরা প্রকৃতির ময়লা পরিষ্কারক বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একবার আমার এক ভারতীয় বন্ধু পাখির ছবি তুলতে গিয়ে সাদা-কালো পাখিটিকে দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। ভারতে তাঁর রাজ্যে এই সুন্দর পাখি নাকি দুর্লভ। অথচ ময়লার ভাগাড়ে ঘুরে বেড়ায় বলে আমরা ওর সৌন্দর্যের খোঁজ করি না। কিন্তু ময়লা-আবর্জনা খেয়ে সে আমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে কতই–না অবদান রাখছে? যাহোক, ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগপর্যন্ত প্রকৃতির এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটালাম। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ওদের ছবি তুললাম।

যে পাখি নিয়ে এতক্ষণ গল্প করলাম, সে আমাদের চিরচেনা ও বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি গো-শালিক। গোবরে শালিক, গুয়ে-শালিক বা গো–সারগ নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম এশিয়ান পাইড স্টারলিং বা পাইড ময়না। স্টারনিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Gracupica contra। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা মেলে।

গো-শালিকের দৈর্ঘ্য ২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৭৭ গ্রাম। একনজরে সাদা-কালো পাখি। মাথা, গলা ও বুকের উপরিপাশ কুচকুচে কালো। গালজুড়ে চওড়া সাদা ছোপ। বুক ও কোমর সাদা। পেট-লেজতল ময়লাটে সাদা। ডানা, পিঠ ও লেজ কুচকুচে কালো। চোখের চারদিকে পালকহীন ত্বক উজ্জ্বল কমলা। ঠোঁটের গোড়া কমলাটে লাল ও আগা সাদাটে। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল হলুদাভ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পালক ফ্যাকাশে, কালো পালকগুলো ধূসর কালচে বাদামি। গালের ছোপ ময়লা সাদা। ঠোঁট কালচে হলুদ। পা ও আঙুল কালচে ধূসর।

ওরা দেশজুড়ে বিস্তৃত। চষা জমি, জলাভূমির গাছপালা, আবর্জনার স্তূপ, গোয়ালঘরের আশপাশে এবং গ্রাম ও শহরের আনাচকানাচে একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। রাতে দল বেঁধে বড় বড় গাছে আশ্রয় নেয়। পোকামাকড়, কেঁচো, শামুক, ফুলের
রস, শস্যদানা, বীজ, ভাত, রুটি— সবকিছুই খায়। সচরাচর ‘টুইই…টুইই…’ শব্দে ডাকলেও ভাতশালিকের মতো বিভিন্ন রকমের ডাক দিতে সক্ষম।

মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। এ সময় গাছের জুতসই ডাল, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটিতে খড়কুটো জড়ো করে বড়সড় ও বেঢপ আকারের গোলগাল বাসা বানায়। প্রতিটি গাছে এক থেকে চারটি বাসা থাকতে পারে। ডিম পাড়ে ৪ থেকে ৬টি, রং চকচকে সবুজাভ-নীল, যা ফোটে ১৫ থেকে ২১ দিনে। ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালন–পালন স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ছানারা তিন সপ্তাহে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় পাঁচ বছর।

  • পরিবেশ
  • পরিযায়ী পাখি
  • পাখি
  • প্রকৃতি