গণপদযাত্রা শেষে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান

নিজেস্ব প্রতিবেদক , সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫






                                        
                                       

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয়া ও কোটা সংস্কারের এক দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। এদিন জেলা শহরগুলোতে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা সহকারে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ১৪ জুলাই গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার পর এই আলটিমেটাম দেন তারা। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে পুলিশকে আরো ২৪ ঘণ্টা সময় দেন তারা। এদিকে শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঠেকাতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবন অভিমুখে এগিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও পদযাত্রা করে নিজ নিজ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।

পদযাত্রার উদ্দেশ্যে বেলা ১১টা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন। পরে দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। হলপাড়া, ভিসি চত্বর, টিএসসি, শাহবাগ হয়ে পদযাত্রাটি মৎস্য ভবন মোড়ে পৌঁছায়। এরপর প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ হাইকোর্টের মাজারসংলগ্ন রোড দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে। পরে শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ওই রোড অতিক্রম করে শিক্ষা ভবনের সামনে পৌঁছালে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করার চেষ্টা করে।

সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে সামনের দিকে অগ্রসর হন। এরপর পদযাত্রা নিয়ে সচিবালয়ের কাছে পৌঁছে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে সচিবালয়ের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়।

শিক্ষার্থীরা গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে পৌঁছালে পুলিশ আবার তাদের গতিরোধ করে থামানোর চেষ্টা করে। সামনে এগোতে না পেরে সেখানেই সড়কে বসে পড়েন তারা। একপর্যায়ে বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে জিরো পয়েন্টের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনের দিকে রওয়ানা হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীরা বাদানুবাদে জড়ান। শিক্ষার্থীরা সামনে অগ্রসর হয়ে গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের কাছে পৌঁছালে পুলিশ ফের তাদের গতিরোধ করে। সেখানে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান দেখা যায়। এ সময় বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তবে মতিঝিলের রাস্তা আটকে রাখেন পুলিশ সদস্যরা। গুলিস্তান মোড়ে এপিসি কার ও জলকামান নিয়ে শত শত পুলিশ সদস্যকে প্রস্তুত থাকতেও দেখা যায়।

পরে বেলা আড়াইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরমের ১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যান। তাদের মধ্যে ছিলেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, মো: মাহিন, আব্দুল কাদের, আব্দুল হান্নান মাসউদ, আরিফ সোহেল, আশিক আহমেদ, নিদ্রা ও সুমাইয়া আখতার এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম ও রশিদুল ইসলাম রিফাত। প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আদিল চৌধুরীর কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। বিকেল ৩টার দিকে তারা বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে আসেন।

স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরি (নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড) থেকে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়। ওই বছরের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু সেই পরিপত্রে দেশের শিক্ষার্থীদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ, শিক্ষার্থীরা সব গ্রেডের সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল। তাই শিক্ষার্থীদের দাবি হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে (সর্বোচ্চ ৫%) এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে।

রাষ্ট্রপতিকে শেষ আশ্রয়স্থল উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে বলা হয়, ছাত্রসমাজের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আপনার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে বাধিত করবেন।

এতে শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, আমাদের কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হোক, তা আমরা কখনোই চাই না। আমরা দ্রুতই পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। ছাত্রসমাজ আশা রাখে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে বাধিত করবেন।

এদিকে স্মারকলিপি দিয়ে বের হয়ে ওইদিনই বেলা ৩টা ২০ মিনিটে রাজধানীর গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি বলেন, এক দফা দাবিতে আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছি। আমরা এ দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চাই।

নাহিদ ইসলাম বলেন, আজ আমাদের থামানো যায়নি। আমরা চাইছি না কঠোর কর্মসূচিতে যেতে। আমরা চাই দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের দাবি মেনে নেয়া হোক। ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এরপর আমরা সে অনুযায়ী পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করব।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের এ সমন্বয়ক আরো বলেন, মামলা সরানোর জন্য পুলিশকে আমরা আগে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলাম; কিন্তু এখনো মামলা সরানো হয়নি। এখন সময় ২৪ ঘণ্টা আরো বাড়ানো হলো মামলা সরিয়ে নিতে; না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি নিয়ে সবাইকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করব।

এ দিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে সচিবালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। শিক্ষার্থীদের পদযাত্রার সময় বিদ্যুৎ ভবনের দিকের গেট ছাড়া সচিবালয়ের অন্য সব গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। কিছু সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সচিবালয়ে ১ ও ২ নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর এক নম্বর গেট খুলে দেয়া হলেও সচিবালয়ের সামনে দুই নম্বর গেটের দিকে সড়কটি বন্ধ থাকে।

দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান : বেলা ১টায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: আবদুল মালেকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেয় শিক্ষার্থীদের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এর আগে বেলা ১১টায় নগরের ষোলশহর স্টেশনে সমবেত হন বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে পদযাত্রা করে দুই নম্বর গেট, জিইসি, কাজীর দেউড়ি, লাভ লেন হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান তারা।

ময়মনসিংহ ও বাকৃবি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বেলা ৩টায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। এর আগে বেলা ১১টায় মুক্তমঞ্চের সামনে জড়ো হয়ে পদযাত্রা করেন তারা। এ ছাড়া আনন্দ মোহন সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে পদযাত্রা করে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

কুমিল্লা শহরের পুলিশ লাইন্স থেকে বেলা ১১টায় পদযাত্রা নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংহতি সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।

এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল সিটি কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা পৃথক মিছিল নিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আসেন। সেখানে ঘণ্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন।

কুষ্টিয়া শহরে সকাল সাড়ে ১০টায় পদযাত্রা শুরু করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। পরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন তারা।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক পদযাত্রা শেষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

  • কাগজ
  • কাগজের পত্রিকা
  • জাতীয় কাগজের পত্রিকা
  • দৈনিক কাগজের পত্রিকা