ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, ৫৪ বছরে অনেক দলকে দেশ শাসন করতে দেখেছি। কিন্তু ইসলামকে এখনো ক্ষমতায় নিতে পারিনি। এবার ইসলামপন্থিদের ঐক্যের ব্যাপারে গণপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচনে শুধু ইসলামি দলই নয়, বরং দেশপ্রেমিক আরও অনেক রাজনৈতিক দলও ‘এক বাক্স’ নীতিতে আসতে পারে। যদি একত্রে নির্বাচন ও কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে পারি, তাহলে দেশে ইসলামপন্থিরাই হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
শনিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সংস্কার, বিচার ও পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন-এই তিন দফা দাবিতে মহাসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে উদ্যানটি রীতিমতো জনসমুদ্রে রূপ নেয়। এই সমাবেশের মঞ্চে ছিলেন-জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ নেতা। মহাসমাবেশ থেকে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনসহ ১৬ দফা ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়।
চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল। এতো জনসমর্থন নিয়ে আর কোনো সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। আমরা নিঃস্বার্থভাবে এই সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছি। সরকারকে বলব-সংস্কার, বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে অঙ্গীকার নিয়ে আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকুন। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবেন না। নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করুন।
চরমোনাই পীর বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানকেও আমরা অতীতের মতো ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। আবু সাঈদ ও মুগ্ধরা আমাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। আহতরা এখনো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার এখনই করতে হবে। পতিত স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। আরেকটা কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করার কোনো বিকল্প নেই। আজকের এই জনসমুদ্র পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষের জনসমুদ্র।
তিনি বলেন, সংস্কার না করেই নির্বাচন আয়োজন করে দেশকে আবারও আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সংসদের উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মতো বিষয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে অবস্থার এখনো পরিবর্তন হয়নি বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।
তিনি বলেন, একটি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। কারও নাম ধরে সমালোচনা করতে চাই না। তবে পুরোনো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি জিইয়ে রাখার চেষ্টা সহ্য করা হবে না। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিকে প্রতিহত করতে হবে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও গণমানুষের জীবনমান উন্নত করা।
তিনি বলেন, বিচারের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও পতিত সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপি এবং নেতা এখনো জেলের বাইরে। অনেকেই দেশের বাইরে থেকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। অবিলম্বে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে অতীতের মতোই বাতাসে নানারকম কথা ভাসছে। আমাদের চোখ-কান খোলা রেখেছি। যোগ্যদের বাদ দিয়ে যদি তথাকথিত ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’দের নিয়োগ দেওয়া হয়, তা কারও জন্যই সুখকর হবে না।
ইসলামী আন্দোলনসহ যেসব রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় তাদের উদ্দেশে চরমোনাই পীর বলেন, গ্রাম-মহল্লা ও ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করুন। সব ভোটারের কাছে গিয়ে দাওয়াত দিন। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়ার বিষয়টি জনগণকে জানাতে হবে।
আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া আগামী নির্বাচন দেশের মানুষ মানবে না।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কিছু আচরণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। দৃশ্যমান সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। যারা বলেন ক্ষমতায় গেলে সংস্কার করবেন, তারা কীভাবে বুঝলেন তারা ক্ষমতায় যাবেন?
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সংস্কার সম্পন্ন করেই হতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। দেশের প্রতি শকুনের নজর পড়েছে। ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সব দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, দু-একটি দলের কথায় সংস্কার নকশায় পরিবর্তন আনা যাবে না। সংস্কার কমিশনকে একটি দলকে প্রাধান্য না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, নতুন বাংলাদেশে নতুন সিস্টেম পরিচালিত হবে। মুজিববাদ আর চলতে পারে না। দখলদার ও চাঁদাবাজদের জায়গা দেশে আর হবে না। দেশি-বিদেশি কোনো শক্তি বাংলাদেশে সংস্কার দাবিয়ে রাখতে পারবে না। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড ও জুলাই গণহত্যার অবশ্যই বিচার করতে হবে।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আগামী নির্বাচনে কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তিকে সামনে রেখে কিছু হবে না। চব্বিশ পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই ঐক্যবদ্ধ। কারও অপপ্রচার বা প্রোপাগান্ডায় কিছু যায়-আসে না।
তিনি বলেন, বিগত দিনে পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিতদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আগামীতে দেশ, জনগণ ও খুনিদের বিচার প্রশ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব। আমরা এক থাকলে হাসিনার মতো কেউ আর আসতে পারবে না। যত বড় খুনিই হোক তাদের প্রতিহত করা হবে। তিনি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন লক্ষ্য করছি, মব জাস্টিস, চাঁদাবাজ ও দখলদার চলছে। ইসলাম কখনো মব জাস্টিস, দখলদার ও চাঁদাবাজ পছন্দ করে না।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের গোলামি ও আমেরিকার কর্তৃত্ব করার জন্য গণ-অভ্যুত্থানে কেউ রক্ত দেননি। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি এবং ইসলামকে ক্ষমতায় নেব-এ নীতি আদর্শে বিশ্বাস করি তাহলে সামনে সুদিন আসবে।
এদিকে সকাল থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বাইরে শাহবাগ থেকে পল্টন মোড় ও কাকরাইল মসজিদ, অন্যদিকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। বেলা ১১টা থেকে জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বক্তব্য দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মহাসমাবেশ শুরু হয় দুপুর ২টায়।
১৬ দফা ঘোষণাপত্রে যা আছে: মহাসমাবেশে ১৬ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সংবিধানের মূল নীতি হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি’ এ বিষয়টি অবশ্যই পুনঃস্থাপন করতে হবে। সংসদের প্রস্তাবিত উভয়কক্ষে (নিম্ন ও উচ্চকক্ষ) সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে। প্রয়োজনীয় মৌলিক রাষ্ট্র সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি বিদেশে পলাতক অপরাধীদের আটক করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে।
ভারতের সঙ্গে কৃত সব চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং সব দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পূর্বে দেশে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সাংগঠনিক সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) শাহ ইফতেখার তারিক ও সহ-প্রচার সম্পাদক মাওলানা কেএম শরীয়াতুল্লাহর সঞ্চালনায় মহাসমাবেশে আরও বক্তব্য দেন-জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালউদ্দিন আহমদ, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক প্রমুখ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, দলটির নেতা মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী, মুহাদ্দিস আব্দুল হক আজাদ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান প্রমুখ।