ইলিশ বাড়ছে না কমছে? হিসাব করে সবাই, খবর রাখে না জেলেদের

নিজস্ব প্রতিবেদক , সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫






                                        
                                       

ইলিশ বেড়েছে নাকি কমেছে? সেই হিসাব আছে অনেকের কাছেই। সরকারের খাতায় ইলিশ আহরণের হিসাব উর্ধ্বমুখী। জেলে-আড়তদারদের কেউ লাভে, কেউ লোকসানে। আয়-ব্যয়ের এই হিসাব সবার কাছে থাকলেও ইলিশ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ কিংবা প্রাণ হারানো জেলেদের খবর রাখেন কয়জন?

গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- ঝড়, জলচ্ছ্বাস, বা নৌকাডুবির শিকার হন। এমন পরিস্থিতিতে, অনেকে নিখোঁজ হন এবং তাদের মরদেহও সবসময উদ্ধার করা যায় না। পরিবার জানতেই পারে না নিখোঁজ জেলে বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। বহু বছর পরে কালেভদ্রে দুই-একজন ফিরে আসে বলে হতভাগ্য পরিবারের সদস্যরা আশায় বুক বাঁধেন- হয়তো একদিন ফিরবে তার স্বজন; কিন্তু অপেক্ষার প্রহর তাদের শেষ হয় না।

গত দশ বছর ধরে এমন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার নিখোঁজ জেলেদের স্বজনরা। বিশেষ করে দুর্যোগ মৌসুমে নিখোঁজ জেলে পরিবারে স্বজনদের কান্নার শব্দ শোনা যায়।

জানা গেছে, সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত দুর্যোগ মৌসুম। আর এই দুর্যোগ মৌসুম মানেই উপকূলবাসীর জন্য বন্যা কিংবা জলচ্ছ্বাসের আতঙ্ক। সেই সাথে জেলে পরিবারগুলোতে থাকে স্বজন হারানোর ভয়।

চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্যমতে, উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছে। নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২৮১ জন। অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার। এসব জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ শিকার করে। এ অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রগামী ৭ হাজার ট্রলার রয়েছে। এসব জেলেদের মধ্যে ২০১৫ সালে ১১ জন, ২০১৬ সালে ১৯ জন, ২০১৭ সালে ৫ জন, ২০১৯ সালে ৪৮ জন, ২০২০ সালে ৯ জন, ২০২১ সালে ৯ জন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ জন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৫ জন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ জন জেলে নদী ও সাগরে নৌকা ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন।

২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো সব জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক প্রদান করা হয়েছে। তবে ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ ৬৬ জেলের মধ্যে ২২ জেলে পরিবারকে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫৮ জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক প্রদান করা হয়েছে।

অন্যান্য সময় জেলে পরিবার আর্থিক অনুদানের চেক পেলেও উপজেলা মৎস্য কার্যালয় জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো জেলে পরিবারের ভাগ্যে কোনো অনুদান জুটেনি।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় আরও জানিয়েছে, বিগত বছরের তুলনায় চরফ্যাশন উপজেলায় ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২২ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ১২৪ জন জেলে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে। এদের অনেকের লাশ পাওয়ার গেলেও অন্যদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ জেলেরা হলেন চর মাদ্রাজ, আসলামপুর, মাদ্রাজ, জিন্নাগড়, আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, আহম্মদপুর, ওসমানগঞ্জ, এওয়াজপুর, হাজারীগঞ্জ, জাহানপুর, রসুলপুর, চর মনিকা, চর কুকরি মুকরি, চর পাতিলা, নজরুল নগর, মুজিব নগর, ঢালচর, নুরাবাদ, নীলকমল, আব্দুল্লাহপুর, চরকলমী এলাকার।

নুরাবাদ এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে মো. জামাল (৩৭)। ২০১৯ সালের ১২ জুলাই, সাগরে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন। তার বাবা বলেন, সংসারের অভাব মেটানোর জন্য ছেলেটা দিন-রাত সাগরে পড়ে থাকত। কূলে ফেরার দুই দিন আগেই আকস্মিক এক ঝড়ে তাদের ট্রলার ডুবে যায়। সেদিন ট্রলারে থাকা অন্য জেলেরা বেঁচে আসলেও আমার ছেলেসহ দুই জেলে খোঁজ পাওয়া যায়নি। জেলে জামালের মতো একই এলাকার আবদুল জলিল (৪৫), শাহাজাহান (৪২), সুলতান মাঝি (৪৬), আফসার জমাদার (২৯), শাহাজাহান মাঝি (৪১), আব্দুল হাই (৩২), কবির (২৬), নূরনবী (২৮), নজরুল ইসলাম (৩৩) নিখোঁজ রয়েছেন।

আবুদুল্লাহপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রফিক বিশ্বাসের ছেলে জামাল বিশ্বাস ও একই এলাকার মদিজ মুনশির ছেলে মো. আব্বাস নদীতে মাছ শিকারে গিয়ে ফিরে আসেননি। তারা একইদিনে নিখোঁজ হন। ২০২০ সালের ১৮ জুন, গভীর রাতে প্রচন্ড ঝড়ে তাদের নৌকা ডুবে গেলে সাথে থাকা অন্য জেলেরা সাঁতরে পার্শ্ববর্তী চরে উঠলেও জামাল বিশ্বাস ও আব্বাসের খোঁজ মেলেনি।

সামরাজ মৎস্যঘাট জেলে সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা জেলে পেশায় নিয়োজিত। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি জেলে পরিবারকেও একই হারে এ অর্থ প্রদান করা হবে। ঝুঁকি এড়াতে জেলেদের মাঝে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী লাইফ জ্যাকেট বিতরণসহ সতর্কতামূলক পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

  • ইলিশ
  • ভোলা