অর্থনৈতিক চাপে জনসংখ্যা হ্রাসের পথে ভারত, প্রজনন হার নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক , বুধবার, ১১ জুন, ২০২৫






                                        
                                       

ভারতে নারীদের গড় প্রজনন হার ১.৯-এ নেমে এসেছে, যা জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় ২.১-এর নিচে। অর্থাৎ, ভারতের মহিলারা এখন আগের তুলনায় কম সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে জনসংখ্যা হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।

বুধবার (১১ জুন) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে দ্য হিন্দু।

তবে এই প্রবণতা শুধু ভারতের নয়; বিশ্বের অনেক দেশেই প্রজনন হার কমছে বলে জানানো হয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর ‘স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে, যা মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫০ সালে একজন নারীর গড় সন্তান ছিল ৫, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২.২৫-এ। যদিও বিশ্বের জনসংখ্যা ১৯৫০ সালের পর তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক প্রজনন হার গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিস্থাপন স্তর ২.১-এ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত স্বাভাবিক গতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে পেরেছে। ১৯৬০ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল ৪৩.৬ কোটি, যেখানে একজন নারী গড়ে ছয়টি সন্তান জন্ম দিতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজননস্বাস্থ্য সেবা, নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা বিস্তারের ফলে এ হার কমেছে।

তবে প্রতিবেদনে এটিও বলা হয়েছে, ভারতের নারীসহ বিশ্বের নারীরা তাদের মায়েদের তুলনায় এখন অনেক বেশি অধিকার ও পছন্দের সুযোগ পাচ্ছেন। তারপরও তারা এখনো কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যা নির্ধারণ ও সেই অনুযায়ী সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ক্ষমতায়িত নন।

২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারতের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১৪৬.৩৯ কোটিতে এবং আগামী ৪০ বছরে তা ধীরে ধীরে ১৭০ কোটিতে পৌঁছাবে, তারপর হ্রাস পেতে শুরু করবে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

ইউগভ নামে এক সংস্থার পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত এ প্রতিবেদনে ১৪টি দেশের ১৪,০০০ জন মানুষের মতামত নেওয়া হয়, যার মধ্যে ভারত বিশ্বের ৩৭ শতাংশ জনসংখ্যা প্রতিনিধিত্ব করে।

জরিপ অনুযায়ী, ভারতের ৬৮ শতাংশ জনগণ ১৫-৬৪ বছর বয়সের মধ্যে, অর্থাৎ কর্মক্ষম, যা দেশের জন্য একটি সম্ভাব্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে জনগণের হার মাত্র ৭ শতাংশ।

ভারতের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা -৫ অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে প্রজনন হার ছিল ২.০, যা জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শহরে এই হার ১.৬ এবং গ্রামে ২.১, যেখানে ১৯৯২-৯৩ সালে গ্রামে ছিল ৩.৭ ও শহরে ২.৭। বিহার (২.৯৮), মেঘালয় (২.৯), উত্তরপ্রদেশ (২.৩৫), ঝাড়খণ্ড (২.২৬) ও মণিপুর (২.২) প্রজনন হারে জাতীয় গড়ের চেয়ে এগিয়ে।

প্রজনন সিদ্ধান্তে আর্থিক চাপের প্রভাব

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ গর্ভনিরোধক ব্যবহার করছেন; বিবাহিত নারীদের মধ্যে এ হার ৬৮ শতাংশ। জরিপ অনুযায়ী, ৪১ শতাংশ নারী মনে করেন দুটি সন্তান যথেষ্ট, আর ১২ শতাংশ নারী মনে করেন দুইয়ের বেশি সন্তান আদর্শ।

তবে বাস্তব ও প্রত্যাশার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ৫০ বছরের নিচে প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন তারা বাস্তবে যত সন্তান চান, তত নিতে পারবেন না।

সন্তান না নেওয়ার বা কম নেওয়ার পেছনে অনেক কারণ উঠে এসেছে: স্বাস্থ্যের অবস্থা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও পারিবারিক চাপ। ভারতের ক্ষেত্রে, ৩৮ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতা তাদের সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। ২১ শতাংশ নারী চাকরির অনিশ্চয়তা বা বেকারত্বকে দায়ী করেছেন।

পারিবারিক প্রভাবও কম নয়—১৯ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গী কম সন্তান চান এবং ১৫ শতাংশ বলেছেন, সঙ্গী গৃহস্থালি ও শিশুসন্তানের যত্নে সহায়তা করেন না।

এছাড়া চিকিৎসাকর্মীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের ১৪ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের চাপের কারণে তারা চাইলেও কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যা নিতে পারেননি বা পারবেন না বলে মনে করেন।

এই প্রতিবেদন ভারতের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ ধারা, নীতিনির্ধারণে নারীর অবস্থান এবং আর্থসামাজিক বাস্তবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

  • ভারত
  • শিক্ষা